(এক)
বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে জাতীয় ঐক্য। একটি জাতির সংকটকালীন সময়ে জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নটি সামনে চলে আসে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ যে কয়টি সংকট অতিক্রম করেছে তার মধ্যে অন্যতম সমস্যা হচ্ছে জঙ্গি এবং সন্ত্রাসবাদের প্রাণঘাতি ছোবল। সম্প্রতি গুলশান আর্টিজানে হামলার মাধ্যমে সন্ত্রাসীরা আমাদের মানচিত্রের ওপরে থাবা দিয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় যে দলই ক্ষমতায় থাকে, জাতির সংকটকালে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা তাদেরই দায়িত্ব। জাতির এ সংকটকালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। দেশের সব রাজনৈতিক দল, শ্রেনী-পেশার মানুষ এমন আহবানকে অভিনন্দন জানালেও আওয়ামী লীগ তার অতীত চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী তা প্রত্যাখান করছে। মূলত আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর জাতীয় ঐক্যের পরিবর্তে বরাবরই বিভাজনের রাজনীতিকে উস্কে দিয়েছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ও দলীয় স্বার্থের উর্ধ্বে আওয়ামীলীগ জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে পারেনি। ২০০৮ সালের বিডিআর বিদ্রোহের মাধ্যমে এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যার পরও আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের জাতীয় ঐক্যের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে অনেক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সে হামলার লক্ষ্য ছিল আমাদের সামরিক শক্তিকে দূর্বল করে দেয়া। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে আওয়ামী লীগ দেশের স্বার্থের পরিবর্তে কার স্বার্থ রক্ষা করছে? সম্প্রতি গুলশানের আর্টিজান বেকারীতে হামলার মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপরে যে আঘাত হেনেছে, সেই সংকটকালীন সময়েও আওয়ামীলীগ জাতীয় ঐক্যের পরিবর্তে হিংসা-বিদ্বেষ আর বিভাজনের রাজনীতি করছে। যা দেশের জনগণ মোটেই প্রত্যাশা করে না।
বাংলাদেশের ইতিহাসের বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ দলীয় স্বার্থের ওপরে জাতীয় স্বার্থকে কখনোই অগ্রাধিকার দিতে পারেনি। জাতি বিভাজনের বীজ বপন হয়েছিল ১৯৭১ সালে। তার নেতৃত্বও ছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু সে সমযের বিভক্তি, পরস্পরের বৈরিতা ইতিহাসের এক যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো কেন? কে কিংবা কারা ছিলো এ বিভক্তির জন্যে দায়ী? অথবা কি সেই ঘটনাবলি যা সৃষ্টি করেছিলো এ জাতীয় দুর্ঘটনার? তা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিশিষ্ট সিনিয়র সাংবাদিক ও সম্পাদক জনাব আবুল আসাদ লিখেছেন-“স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলনের গোটা সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব বিরাজ করেছে। তারপর স্বাধীনতা যুদ্ধকালেও তারই একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিলো। কিন্তু যা জাতীয় মত বিভক্তি রোধ করতে পারতো, পদক্ষেপের ক্ষেত্রে সে ধরনের সুষ্পষ্টতা আওয়ামী লীগের ছিলো না এবং দল মত নির্বিশেষে সবাইকে কাছে টানারও জাতীয় সমঝোতা সৃষ্টির সে ধরনের উদ্যোগ আওয়ামী লীগের তরফ থেকে নেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ সংখ্যা গরিষ্ঠ দল হিসেবে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার জন্যে তৈরি হচ্ছিলো। আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে অনেকেই দেখা করে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে তাঁর আন্দোলনের প্রতি তাদের সমর্থন ঘোষণা করেছেন, কিন্তু শেখ মুজিব সব দলকে ডেকে কোন আলোচনা করেননি।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থানের ফল একা কুক্ষিগত করে সবাইকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ যেমন একাই এগিয়ে গিয়েছিলো, ঠিক তেমনিভাবে অসহযোগ আন্দোলনের ফল ভোগ সে কাউকেই শরিক করতে চাইলো না। যেন সে নিশ্চিত ছিলো ক্ষমতা হস্তান্তর হচ্ছে এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাচ্ছে। এ না হয়ে স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা যুদ্ধের চিন্তা যদি তাদের মাথায় থাকতো, তাহলে আসন্ন স্বাধীনতা সংগ্রাম বা স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্যে আওয়ামী লীগের এ মানসিকতা ছিলো অযৌক্তিক, অনুপযুক্ত এবং ক্ষতিকর। কারণ স্বাধীনতা যুদ্ধ হয় সকলের। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের উচিত ছিলো সব দলকে কাছে ডেকে এবং তাদের আস্থায় নেয়া ও তাদের আস্থা অর্জন করা যাতে করে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কোন ভুল বুঝাবুঝি থাকলে তা দূর হয় এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদেরকে পাওয়া যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ এটা করেনি। আন্দোলনের নেতা হিসেবে আওয়ামী লীগের এটা একটা বড় ব্যর্থতা।”
(দুই)
Divide and rule “ভাগ কর শাসন কর”। এটি হলো ঐক্যের বিপরীত। রাজনীতিতে একটি পুরাতন বিট্রিশ নীতি বা তত্ব হিসেবে পরিচিত। Wikipedia-তে বলা in politics and sociology is gaining and maintaining powerby breaking up larger concentrations of power into pieces that individually have less power than the one implementing the strategy.
জাতি বিভাজকেরা আমাদের রাষ্ট্রকে কবব্জা করে নিয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই একটি গোষ্ঠী দেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে বিভাজন, হিংসা ও ঘৃণা ছড়াচ্ছে। বিভাজনের চুড়ান্ত পর্বটি সম্পন্ন হয়েছে শাহবাগী আয়োজনের মধ্যে দিয়ে। এ কালো রেখা আমাদের তরুন প্রজন্ম ও কোমলমতি শিশুদের পর্যন্ত গ্রাস করে নিয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগ-বিএনপি ইচ্ছা -অনিচ্ছার উপর এখন জাতীয় ঐক্য নির্ভর করেনা। আমাদের জাতীয় ঐক্যের বিভাজনের রিমোট কন্ট্রোল এখন এদেশের জাতীয় নেতাদের হাতে আছে কি? অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে অনেক শক্তিধর রাষ্ট্র এখন তার নিয়ন্ত্রা। অথচ আমাদের দেশের কিছু কিছু বুদ্ধিজীবি বুঝে না বুঝে বিএনপি-জামায়াতের জোট ভাঙার নসিহত করছেন। এই আত্নঘাতি পরামর্শকরা কার স্বার্থ নিয়ে সরব সেটিই বড় প্রশ্ন। মনে রাখতে হবে রাজনীতি আর বুদ্ধিজীবিতা এক নয়।
“গ্রামসি মনে করেন, প্রত্যেক মানুষেরই বুদ্ধিজীবী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে, যেহেতু তার আছে বুদ্ধি প্রয়োগ করার ক্ষমতা। ÔAll men are intellectual, one could therefore say; but not all men have in society the function of intellectual’ এদেশে আমরা এখন বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্বের যুগে বাস করছি। একদিকে আমাদের প্রথাগত বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের দাসত্ব গ্রহণ করেছেন। এদের কাজ হচ্ছে রাজনৈতিক সমাজের শোষণ-দমনপীড়নমূলক কর্মকা-কে বিভিন্ন কৌশলে আড়াল করে রাখা এবং মহৎ কর্ম বলে প্রচার করা। আরেকদিকে সাম্প্রতিককালে গণমাধ্যমের বিরাট বিস্তার ও কারিগরি উন্নতির পরিসরে নয়া-পুঁজির উমে সৃষ্টি হয়েছে ‘বিশেষজ্ঞ’, ‘বিশ্লেষক’, ‘পরামর্শক’, ‘কলামিস্ট’ ইত্যাদি বিচিত্র নামের অনেক বুদ্ধিজীবী-দাস।
এরা রাজনৈতিক সমাজ থেকে শুরু করে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় সরাসরি নিযুক্তি নিয়ে কাজ করে ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য। ব্যক্তিগত স্বার্থ বলতে সম্মানী, বেতন, ভাতা, প্রকল্প ইত্যাদি খাতে প্রদত্ত অর্থও আছে। এই উভয় দলই অত্যন্ত সচেতনভাবে, পরিকল্পনা করে স্বাধীন বুদ্ধিজীবী বিকাশের সবগুলো পথ রুদ্ধ করে রাখে”।
আমাদেরকে মনে রাখতে হবে ১৯৪৭ সালে এ ভূ-খন্ডের মানুষের রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টিতে ধর্মের একটা বিশেষ প্রেরণা বা ভূমিকা রয়েছে। এটিকে অস্বীকার করে কখনোই জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হবে না। অথচ এখন মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামের প্রতিপক্ষ বানিয়ে আওয়ামী লীগ আরেকটি ঐতিহাসিক ভুলের পুনরাবৃত্তি করেছে।
ইসলাম আর মুসলিম যদি সাম্প্রদায়িক চেতনার বিপরীত হয় তাহলে আওয়ামী লীগের জন্মইতো সেই ভ’লের ভিতর দিয়ে নয় কি? আজকের ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগের শুরুই হয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে। এই দলের প্রাণপুরুষ তরুণ শেখ মুজিব চল্লিশের দশকে অনেক দাঙ্গায় সশরীরে অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৭৪ সালে ইন্ডিয়ার চোখ রাঙানিকে অগ্রাহ্য করে বঙ্গবন্ধু ওআইসির সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ভুট্টোকে এ দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিশেষ দূত হিসেবে পাঠিয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন, তিনি স্বয়ং শাহ আজিজুর রহমান। সিমলা চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে এর পরিসমাপ্তি টানলেন। তাহলে আওয়ামী লীগ কি মনে করে শেখ মুজিবুর রহমানের এসব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ভুল ছিল?
(তিন)
আমাদের রাজনৈতিক বিভক্তির পেছনে অনেক ডকটিনই এখন বিরাজমান। সে ডকটিনের পেছনের কথাগুলো আমাদের তরুণ প্রজন্মকে জানতে হবে। “ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী প-িত জওহরলাল নেহরু কখনো ছোট ও ক্ষুদ্র দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন না। তিনি মনে করতেন, ক্ষুদ্র দেশগুলোর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে এবং একদিন এসব ক্ষুদ্র দেশ ভারতে যোগদান করবে। ‘দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’র ৫৫০ নম্বর পৃষ্ঠায় নেহরু লিখেছেন: Small nation state is doomed. It may survive as a cultural and autonomous area but not as an independent political unit. অর্থাৎ ক্ষুদ্র জাতি রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। এটি সাংস্কৃতিক ও স্বায়ত্তশাসিত এলাকা হিসাবে টিকে থাকতে পারে তবে স্বাধীন রাজনৈতিক ইউনিট হিসাবে নয়”।
‘স্থিতির জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলাতে হবে’ জনাব আকবর আলি খান লিখেছেন-“ধূসর অতীত থেকে একুশ শতক পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ধরে বাংলাদেশে বারবার অস্থিতিশীলতার আবির্ভাব ঘটেছে। প্রাচীন বাংলায় চিন্তা নায়কেরা এই অস্থিতিশীলতাকে মাৎস্যন্যায়বলে অভিহিত করতেন। আভিধানিক অর্থে মাৎস্যন্যায়হলো মাছের মতো অবস্থা, যেখানে বড়মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে এবং ছোট মাছের বাঁচার কোনো অধিকার নেই। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে মাৎস্যন্যায়কখনো একেবারে দূর করা সম্ভব হয়নি। বাংলার জনসাধারণ মনে করে আমরা সিংহাসনের প্রতি বিশ্বস্ত; সিংহাসন যিনি দখল করে থাকেন আমরা তাঁরই বাধ্য; তাঁরই প্রতি আমরা অনুগত।’ এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এখনো অব্যাহত রয়েছে।” (নভেম্বর ০৬, ২০১৪)
ভারতের প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মারকান্দাইয়ে কাৎসু অখ- ভারত কায়েমের আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন। ২০১৩ সালের ৭ এপ্রিল হায়দরাবাদে ‘রিপোর্টিং টেরর: হাউ সেন্সেটিভ ইজ মিডিয়া?’ শিরোনামে এক সিম্পোজিয়ামে বলেছেন, “পাকিস্তান একটি ভুয়া দেশ। একদিন বাংলাদেশসহ দেশটি ভারতের সঙ্গে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হবে”।
অর্থাৎ হিন্দু মহাসভা ঘোষণা করেছে: ভারত অভিন্ন ও অবিভাজ্য। বিচ্ছিন্ন অংশগুলো যতদিন ভারত ইউনিয়নে ফিরিয়ে এনে সেগুলোকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করা না হবে ততদিন শান্তি আসবে না। দ্বিজাতি তত্ত্ব হলো ভারতীয়দের চক্ষুশূল। ভারতের কংগ্রেস পার্টি কখনো দ্বিজাতি তত্ত্ব মেনে নেয়নি। ১৯৪৭ সালের ৫ জুন কংগ্রেস এক প্রস্তাবে বলেছিল: Geography and mountains and sea fashioned India as she is and no human agency can change that shape or come in the way of her final destiny. Once present passions had subsided the false doctrine of two nations will be discredited and discarded by all.
বিশিষ্ট কলামিষ্ট জনাব ফরহাদ মযহার লিখেছেন- “বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজন, সহিংসতা বিস্তৃতি ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবার পেছনে দিল্লীর মদদ, সমর্থন ও সক্রিয় অবস্থানই বাংলাদেশের বর্তমান সন্ত্রাস ও সহিংসতার প্রধান কারন। নিরাপত্তা পরিস্থিতির সংকট আন্তর্জাতিক রূপ পরিগ্রহণ করবার ক্ষেত্রে এটাই মূল কারণ। বাংলাদেশ ও ভারতের শান্তিপ্রিয় ও গণতান্ত্রিক জনগণকে এই সত্য উপলব্ধি করতে হবে। আল কায়েদা, আইসিস ও অন্যান্য সংগঠনের জন্য বাংলাদেশের পরিস্থিতি খুবই উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। ভারতের জনগণকে এই ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে বুঝতে হবে নিজেদের ভূমিকা পর্যালোচনা না করে ক্রমাগত ইসলাম ও বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের চর্চা আগুনে ঘি দেওয়ার অধিক কিছু করবে না। এই সময় দরকার চিন্তার পরিচ্ছন্নতা ও দূরদৃষ্টি। দরকার পরস্পরকে বোঝা ও জনগণের পর্যায়ে সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোকে চিহ্নিত করা। এতোটুকুই শুধু বলা যায় প্রতিবেশীর চালে আগুন লাগলে নিজের ঘরের চালে আগুন ধরা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু দিল্লীকে কে বোঝাবে? (০৮/০৭/১৬-নয়া দিগন্ত)
(চার)
গুলশানের ট্রাজেডিতে গোটা দেশের মানুষ স্তম্ভিত আতঙ্কিত। সারা বিশ্বের দৃষ্টি এখন বাংলাদেশ দিকে। ভয়ে-আতঙ্কে দেশ ছাড়ছে বিদেশীরা। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি থেকে শুরু করে নি¤œশ্রেনী-পেশার মানুষের এক অজানা আতঙ্ক আর শঙ্কা তাড়া করে ফিরছে। মানব সম্পদ, খনিজ সম্পদ ও ভৌগলিক দিক থেকে পরাশক্তির নজরকাড়া জায়গায় এদেশের অবস্থান। অনেক দেশেরই এখন শ্যোনদৃষ্টি এখানে। আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের নখরে রক্তাক্ত আর কালো মেঘে ঢাকা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আজ আক্রান্ত। এমতাবস্থায়ও শাসক গোষ্ঠীর ক্ষমতার লিপ্সা দেখে দেশের ১৬ কোটি মানুষ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। কোন ভাবেই বন্ধ হচ্ছেনা ব্লেম গেইমের রাজনীতি। অযাচিত শর্তের ডামাঢোলে দেখা যাচ্ছেনা জাতীয় ঐক্যের কোন সম্ভাবনা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে ভারতের প্রত্যক্ষ মমদে আমাদের গণতন্ত্র হরণ, দমন-নিপীড়ন ও নানাবিদ রাজনৈতিক সমীকরণের যোগফল হচ্ছে আজকের গুলশান হত্যাকা-। গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি ও শান্তি প্রিয় ইসলামকে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত দাঁড় করানোই সমস্যার আসল কারণ।
গুলশান, শোলাকিয়া, কল্যাণপুর সহ অনেক স্থানে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতায় আওয়ামী পরিবারের প্রমাণ মিলেছে। মৃতদের মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতার সন্তানের লাশ পাওয়ার পরও আওয়ামীলীগ নেতারা বিএনপি-জামায়াতের মধ্যেই জঙ্গি খুঁজছেন? বিকৃত মস্তিস্কের অধিকারী স্বার্থনেস্বী বুদ্ধিজীবি নামক অন্যের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী পরজীবি শাহরিয়ার কবির ও মুনতাসির মামুন গংরা চোখে টিনের চশমা লাগিয়ে অন্যকে দায়ী করে কথা বলছে এখনো নির্লজ্জের মতো? এতদিন মন্ত্রী-এমপিরা মাদ্রাসাকে জঙ্গি প্রজনন কেন্দ্র বলে আসলেও এবার জঙ্গিরা সকলেই দেশের নামী-দামী স্কুল-কলেজ ও ইউনিভার্সিটির ছাত্র ও আওয়ামী পরিবারের সদস্য হওয়ায় আওয়ামীলীগের মুখে কালি পড়েছে!।
এটা সকলেরই জানা গুলশান হামলায় তো কোন মসজিদের খতিব জড়িত ছিলনা। কোন মাদ্রাসার ছাত্রও সম্পৃত্ত ছিলনা। তাহলে নজরদারী কেন মসজিদ-মাদ্রাসায়? সরকার যেন জঙ্গিবাদ রোধে উল্টো পথেই হাটছে? সরকার কার এজেন্ডা বাস্তবায়নে মসজিদে নজর দারির উদ্যোগ নিচ্ছে? এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে আজ সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। দেশের সকল-রাজনৈতিক দল, আলেম-ওলামা ও সকল শ্রেনী-পেশার মানুষের সহযোগীতা ছাড়া সরকার একার পক্ষে শক্তি প্রয়োগ করে জঙ্গিবাদ রোধ করতে পারবেনা।
আমাদের বিভেদের রাজনীতির সুযোগ নিয়ে আধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমাদের মানচিত্র দখলের লড়াইয়ে নেমেছে। এজন্য ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, “আধিপত্যবাদী শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় শিখণ্ডী বসিয়ে দিয়ে একের পর এক গোপন চুক্তি সম্পাদন করে গোটা দেশকে গ্রাস করতে চাচ্ছে। এইভাবে তারা আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে প্রভূত্ব কায়েম রাখতে চায়। সরকারের নতজানু নীতির কারণেই আমাদের আবহমানকালের কৃষ্টি, ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর চলছে বাধাহীন আগ্রাসন”।
সেই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগ আজও মুক্তিযুদ্ধকে জাতির ঐক্য ও সমৃদ্ধির পথে কাজে লাগানোর পরিবর্তে জাতিকে বিভক্ত করে জাতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। দেশের আদালত, সংবাদপত্র, শিল্প, সাহিত্য, প্রশাসন ও সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে ফেলেছে। জাতি বিধ্বংশী এই বিভাজনের রোডম্যাপটি অনেক সুদূরপ্রসারী। আমরা সেই কালো রোডম্যাপ ধরে কেউ হাঁটছি বুঝে, কেউ হাঁটছি না বুঝে। আল্লাহ না করুন তার শেষ পান্তে গিয়ে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের অর্জিত স্বাধীনতার সূর্যটি অস্তমিত হয়ে যেতে পারে! তাই এখনই দেশের জনগনকে সাবধান হতে হবে। জাতীয় ঐক্যেই কেবল অধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ছোঁবল থেকে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে পারে। জনতার ঐক্যই এর রক্ষা কবজ। তাই জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে সব শ্রেনী-পেশার মানুষের পক্ষ থেকে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করতে হবে সরকার ও বিরোধী দলের উপর। আমাদেরকে গড়ে তুলতে হবে জনগনের ঐক্য।
আজকে পশ্চিমাদের প্রধান টার্গেট ইসলাম ও মুসলমান। তাই তারা মুসলিম দেশ গুলোতে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে কৌশলে প্রবেশের পরিবেশ তৈরী করে নেয়। সে আয়োজনের উদ্ধোধন গুলশান হত্যার মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছে এটি আমাদেরকে রাজনীতিবিদদেরকে বুঝতে হবে। গণতন্ত্রের চর্চা, ইসলামের প্রচার-প্রসার ও জনগণের ঐক্যেই কেবল এ ষড়যন্ত্রকে রুখে দিতে পারে। তুরুস্কে জনতার ঐক্য যেমনি রুখে দিয়েছে অবৈধ সেনা অভ্যুত্থানকে। সরকারীদল-বিরোধীদল জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে দাঁড়িয়ে গেছে এক কাতারে। বিশ্বের ইতিহাসে নজির সৃষ্টি করলো । আজ বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় মুসলিম দেশ হিসেবে তুরস্ক থেকে শিক্ষা নিতে পারে। সুতরাং বিভেদ সৃষ্টি না করে জাতীয় সংকট মোকাবেলায় জাতীয় ঐক্যের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু বিভাজনের ইতিহাস ভেদ করে আওয়ামী লীগ এমন উদারতার পরিচয় দিতে পারবে কি? সেটিই এখন দেখার অপেক্ষা…..