নবী করিম ﷺ কোন প্রতিবন্ধকতা কিংবা বিপদ আসার আগে ঝটপট কিছু কাজ সেরে রাখার পরামর্শ দিতেন। তিনি বলেন- ‘তোমরা কার্য সম্পাদনে সাতটি বিষয়ের অগ্রগামী হও। তোমরা কি এমন দারিদ্র্যের অপেক্ষায় আছ, যা আল্লাহ্ তায়ালাকে ভুলিয়ে দেয় অথবা এমন ধনবান হওয়ার, যা আল্লাহ তায়ালার অবাধ্যাচারে লিপ্ত করে অথবা এমন রোগের, যা স্বাস্থ্যকে ধ্বংস করে দেয় অথবা নির্বোধে পরিণতকারী বার্ধক্যের অথবা এমন মৃত্যুর যা হঠাৎ করেই এসে যায় অথবা অপেক্ষা করছ দাজ্জালের অপেক্ষমাণ অদৃশ্য অমঙ্গলের অথব কিয়ামতের? আর কিয়ামত তো আরও বিভীষিকাময়, আরও তিক্ত।’ তিরমিজি
তিনি আরও বলেন- “যে লোক ভয় পায়, সে ভোর রাতেই যাত্রা শুরু করে, আর ভোর রাতেই যে লোক যাত্রা শুরু করে, সে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারে। জেনে রেখ, আল্লাহ তায়ালার পণ্য খুবই দামি। জেনে রেখ, আল্লাহ্ তায়ালার পণ্য হলো জান্নাত।” তিরমিজি
বিপদে আমি না যেন করি ভয়:-
সারা বিশ্বের মানুষ এখনও শঙ্কা উদ্বিগ্নতা নিয়ে সময় অতিবাহিত করছে। আজ যেন দুঃখ ছুঁয়েছে ঘরবাড়ি, উদ্যানে। কড়া নাড়ার মতো কেউ নেই, শুধু শূন্যতার এই দীর্ঘশ্বাস, এই দীর্ঘ পদধ্বনি! মুসলমানরা এই বিশ্বাস করে জীবন হচ্ছে মৃত্যুর ঘনিষ্ঠ সংগী। এ জন্য হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন-“সব দুঃখের মূল এই দুনিয়ার প্রতি অত্যাধিক আকর্ষণ”। কবি বলেছে বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা বিপদে আমি না যেন করি ভয়। হযরত সোলায়মান (আঃ) বলেছেন ”সৎ লোক সাতবার বিপদে পড়লে আবার উঠে কিন্তু অসৎ লোক বিপদে পড়লে একবারে নৃপাত হয় ”। হযরত আবু বকর (রা:) “ মৃত্যুকে খুঁজো (অর্থাৎ, সাহসী হও) তাহলে তোমাদেরকে জীবন দান করা হবে।”
করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত গোটা দুনিয়া। আল্লাহ্ বলেন, ‘আল্লাহ্র অনুমতি ছাড়া কোনো বিপদই আসে না। যে ব্যক্তি আল্লাহকে বিশ্বাস করে তিনি তার অন্তরকে সু-পথে পরিচালিত করেন। আর আল্লাহ সব বিষয়ে সম্যক অবগত রয়েছেন।’ সূরা তাগাবুন, আয়াতঃ ১১
করোনা দুনিয়াকে পাল্টে দিয়েছে! :-
মিশরের একজন প্রাক্তন সংসদ সদস্য বলেছেন-করোনাভাইরাসকে ঘৃণা করবেন না। এটা মানবতা ফিরিয়ে এনেছে। মানুষকে তাদের স্রষ্টার কাছে এবং তাদের নৈতিকতায় ফিরিয়ে এনেছে। এটি বার, নাইট ক্লাব, পতিতালয়, ক্যাসিনো বন্ধ করে দিয়েছে। এটি সুদের হারকে কমিয়ে এনেছে। পরিবারের সদস্যদের একসাথে নিয়ে এসেছে। অশ্লীল আচরণ বন্ধ করেছে। এটি মৃত এবং নিষিদ্ধ প্রাণী খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এখনও পর্যন্ত এর কারণে সামরিক ব্যয়ের এক তৃতীয়াংশ স্বাস্থ্যসেবাতে স্থানান্তরিত হয়েছে। আরব দেশগলোতে শিশা নিষিদ্ধ করেছে। করোনাভাইরাস মানুষকে দুআ করতে বাধ্য করছে। এটি স্বৈরশাসক এবং তাদের ক্ষমতাকে তুচ্ছ করেছে। মানুষ এখন উন্নতি এবং প্রযুক্তির চেয়ে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করছে। এটি কর্তৃপক্ষকে তার কারাগার এবং বন্দীদের দিকে নজর দিতে বাধ্য করছে। এটি মানুষকে শিখিয়েছে কীভাবে হাঁচি এবং কাশি দিতে হয়, যেমনটি আমাদের নবী সাঃ ১৪০০ বছর আগে শিখিয়েছিলেন, করোনাভাইরাস এখন আমাদের ঘরে সময় কাটানো, সহজ জীবনযাপন করা, অহেতুক প্রতিযোগিতা না করতে শিখিয়েছে। একই সাথে আমাদের চেতনা জাগ্রত করার জন্য এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা ও সাহায্য প্রার্থনা করার সুযোগ দেওয়ার জন্য আমরা আল্লাহ্র কাছে শুকর জানাচ্ছি। যারা জ্ঞানী তাদের জন্য এতে একটি দুর্দান্ত মুল্যবান শিক্ষা রয়েছে”। (তথ্য ইন্টারনেট)
হাত মুখ ধোয়ার পরামর্শ ইসলাম দিয়েছে:-
সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা: একি এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী লিখেছেন- ”আজকের চিকিৎসা বিজ্ঞান ও ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন (ডাব্লিউএইচও) কভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রধান অস্ত্র হিসেবে হাত ধোয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। গড়গড়ার সঙ্গে কুলি করতে বলছে। পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করতে বলছে। মুখ ধুতে বলেছে। যা ১৪০০ বছর আগে ইসলাম অর্থাৎ আমাদের নবীজি এই শিক্ষা দিয়ে গেছেন। আমরা যারা মুসলমান, আমাদের নামাজের সময় অজু করতে প্রথমেই হাত ধুতে হয়। গড়গড়া করে কুলি করতে হয় এবং নাকের ভিতর পানি দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়”।
মহামারীর ইতিহাসের পাঠ:-
করোনা নতুন। কিন্তু পৃথিবীতে এই মহামারী নতুন কিছু নয়। এভাবে তিনি দুনিয়ার বুকে বিভিন্ন রকম পরীক্ষা দিয়ে ছাটাই-বাছাই করেছেন ইতিপূর্বে ও। সেই ইতিহাস থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়নি। সময়ের সাড়া জাগানো আলোচক ড: ইয়াসির কাদি বলেছেন- ”পৃথিবীর ইতিহাসে শত শত মহামারীর ঘটেছে। প্রথমটি হলো ধ্বংসাত্মক প্লেগ। ১৩৩২ থেকে ১৩৫০ইংরেজি সন সময়ে পর্যন্ত এই ব্ল্যাক ডেথ অথবা ব্ল্যাক প্লেগ নামে মহামারীটি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এতে সারা দুনিয়াতে প্রায় ২০০ মিলিয়ন (২০ কোটি) মানুষ মারা যায়। বলা হয়ে থাকে যে এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠে জনসংখ্যা স্বাভাবিক হতে ইউরোপের প্রায় ২০০ বছর সময় লেগে যায়। সে সময়ে মুসলিম দেশগুলিও এই ব্ল্যাক ডেথ নামক মহামারীতে আক্রান্ত হয়েছিলো যাতে সে সময়কার অনেক উলামা মারা যান। অনেকেরই পরিবারের সদস্য মৃত্যুবরণ করে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো “স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা’। এটা একশত বছর ১৯১৮ সালে ঘটেছে। সেসময়ে চলা ১ম বিশ্বযুদ্ধের কারণে এটি আরো ভয়াবহ রুপ ধারণ করে যাতে প্রায় ১০০ মিলিয়ন বা ১০ কোটি মানুষ মারা যায়। ‘স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা’ হিসেবে নামকরণ করার কারণ এটা নয় যে এ মহামারী শুধু স্পেনেই ঘটেছিল। বরং সে সময়কার মিডিয়া ব্রিটিশ, কানাডা ও আমেরিকা নিয়ন্ত্রণ করত। তারা তাদের দেশের মহামারী সম্পর্কে মিডিয়াতে তেমনকিছু আসতে দেয়নি। যেটি হয়ত মিডিয়া কন্ট্রোলে হয়ত চায়না করেছে। তাদের অনেক খবরই দুনিয়াবাসী জানতে পারছেনা। যেমন উইঘুর মুসলমানদের উপর দমন-নিপীড়নের পৃথিবীর মানুষের নিকট এখনো উজানাই রয়ে গেলো!। তাই বলছিলাম এই স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা আর বর্তমানে প্রকট হওয়া করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯ একই পরিবারভুক্ত ভাইরাস। যদিও এটা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা এখনো অনেক গবেষণা করে যাচ্ছেন।
সর্বপ্রথম যে মহামারীর কথা আলোচনা করা জরুরী তা হলো ’আমাওয়াসের প্লেগ’। এটি ইমাওয়াস নামক এক শহরের নাম হতে এর উৎপত্তি। মুসলিম উম্মাহ সর্বপ্রথম এই প্লেগের সম্মুখীন হয়। এই প্লেগ থেকে বেঁচে যাওয়া কেউ কেউ এটিকে জাস্টিনিয়ান প্লেগও বলে থাকেন। এটা রোমান সাম্রাজ্যের ৫৪১ খ্রি. হতে ৭৫০ খ্রি পর্যন্ত কয়েকবার ঘটে। রোমান শাসক জাস্টিনের শাসনামলে শুরু হওয়ার কারণে এটিকে প্লেগ অব জাস্টিনিয়ান বলে অভিহিত করা হয়। প্রতিবার এই মহামারিতে কনস্টান্টিনোপলে প্রতিদিন ১০,০০০ মানুষ মারা যেতো। এতে ইউরোপের অর্ধেক জনসংখ্যা আক্রান্ত হয়।
‘আমাওয়াসের’ প্লেগ এগুলির নবী সা. এর ইন্তিকালের পরের ঘটনা। ১৮ হিজরী সনে এটি ঘটে। এটি সে সময়কার কথা যখন ওমর রা. এর নেতৃত্বে মুসলিমরা একের পর এক দেশ জয় করছেন। রোমান সাম্রাজ্যের অধিনস্থ শাম, দামেস্ক, জেরুজালেম প্রভৃতি জয় করেন। এসময় মুসলমানদের সাথে রোমান সৈন্যদের মুখোমুখী যুদ্ধ চলছে। অত্র অঞ্চলে মুসলিম বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ। যিনি জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ জন সাহাবীর অন্যতম। আবু উবায়দা রা. কে উমর রা. সর্বোচ্চ কমান্ডারের দায়িত্ব দেন।
তিনি একটি বাহিনী নিয়ে শামের দিকে রওনা হন যারা পূর্বের বাহিনীর সাথে যোগ দিবে। তিনি যখন শামের কাছাকাছি একটি জায়গায় পৌছলেন তখন জানতে পারলেন সেখানে প্লেগ রোগ মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় সেখানে প্রবেশ করবেন না ফিরে যাবেন সে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য উপস্থিত মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের কাছ থেকে মতামত গ্রহণ করেন। মুহাজিরগণের মধ্যে দুই ধরণের মতামত প্রদানকারী পাওয়া যায়। আনসারগণের কাছ থেকেও একই রকম মতামত পাওয়া যায়।
এসময়ে আব্দুর রহমান ইবনে আউফ বললেন এ বিষয়ে আমি রাসুল সা. থেকে একটি হাদীস শুনেছিলাম। “যদি তোমরা কোনো প্লেগ আক্রান্ত এলাকায় থাকো, তাহলে সেখান থেকে পলায়ন করোনা আর যদি এর বাইরের অধিবাসী হও তাহলে প্লেগ আক্রান্ত এলাকায় প্রবেশ করো না”। তখন এ বিষয়টি সুরাহা হয়ে গেলো। তখন উমর রা. বললেন আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার তাওফিক দিয়েছেন।
লেখক- সহকারী সম্পাদক, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা
চলবে——–