পৃথিবীর ইতিহাসে নাজিবাবাদ বা জাতীয় সমাজতন্ত্র (national socialism) এই মতবাদের প্রবক্তা ছিলেন জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাডলফ হিটলার। তার রচিত ”মেইন কাম্ফ” (main kampf)-ই হলো এই মতবাদের অন্যতম তাত্তি¡ক ভিত্তি। ১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানির রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। উগ্র ও জংগী জাতীয়তাবাদী মতবাদ কায়েমে ব্রত হন। হিটলার বিশ্ব জয়ের জন্য জার্মান জাতিকে উদ্বুদ্ধ করার করতে থাকেন। ১৯৪৫ সালে চক্রীপক্ষ পরাজয়বরণ করলে হিটলারের জীবনাবসান ঘটে। নাৎসীবাদ অনুযায়ী জার্মানিরাই বিশ্বের প্রকৃত এবং নিখুঁত এবং ফলত সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জাতি। এই শ্রেষ্ঠত্বের জন্য জার্মানিরা বিশ্বের অন্যান্য সকল জাতির উপর প্রভুত্ব করবে এটাই তারা মনে করে।
একই মনোভাব পোষন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সেজন্য-ই ইতিহাসে সবচেয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘঠিত হয়েছে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পল্টনে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন পৈশ্চাচিক ও জঘন্য হত্যার ঘটনা খুবই বিরল। তারই ধারাবাহিকতায় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে অত্যান্ত নির্মমভাবে ঠান্ডা মাথায় ঘন্টার পর ঘন্টা আঘাতের পর আঘাত কওে হত্যা করা হয়েছে!! এই জাতির আগামী দিনের একজন শ্রেষ্ঠ কর্নধারকে এভাবে পিটিয়ে মারা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবীহিন। ২৮ আক্টোবর যেভাবে সাপেরমত পিটিয়ে আওয়ামী লীগ রাজপথে মানুষ হত্যা করেছে। সেই একই কায়দায় অবৈধভাবে ক্ষমতায় অধিষ্টিত আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হাজার হাজার মানুষকে গুম,খুন করছে। সেই হত্যা কান্ডের বিচার হলে হয়ত আবররার এর মত অনেককে জীবন দিতে হতো না।
২০০৬ সালের ২৮ রাজপথে পূর্বঘোষিত সেই ন্যাক্কারজনক হত্যাকান্ডের কে হুকুম দিয়েছে কারা নেতৃত্ব দিয়েছে তা কারোই অজানা নয়। এখনো ভিডিও ফুটেজ,ছবিতে তা রয়েছে। বিচারিক আইনে হুকুমের আসামীর সাজা সকলেরই জানা। পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায় যুদ্ধ-বিগ্রহ,খুন-খারাবির মুলে রয়েছে ক্ষমতার লিপ্সা,সম্পদেরমোহ, রাজনৈতিক পতিপক্ষ দমনই আসল উদ্দেশ্যে। আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ জোরকরে ক্ষমতাদখলে রাখতে পাহাড় সমান অপনাধ, ক্যাসিনো দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক পতিপক্ষ দমনে ফাঁসি,জেল-জুলুম-নির্যাতন,হামলা,মামলা দিয়ে ১২ বছরে প্রমান করেছে ২৮ আক্টোবরের মানুষ হত্যার আসল কারণ কি? কেন আওয়ামী লীগ এমন জঘন্য পথ তারা বেছে নিয়েছে সেদিন? পতিপক্ষ দমনে আদর্শ নয়, খুনই তাদের একমাত্র হাতিয়ার।
২৮ ফেবুয়ারী আল্লামা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে সাজার প্রতিবাদ মিছিলে সারা দেশে শতাধিক মানুষকে হত্যা করে। ২৫-২৬ ফেব্রæয়ারি ’০৯ বিডিআর হত্যাযজ্ঞ ,৫ মে শাপলা চত্বওে আলেম-উলামের উপর ইতিহাসের বর্বর নির্যাতন, হত্যাকান্ড, গুম, খুনের হাজার ঘটনা প্রমান করেছে আওয়ামীলীগের বাকশালী চরিত্র পাল্টায়নি। এই পৈশ্চাচিক বর্বরোচিত ঘটনা স্থান কওে নিয়েছে লেলিন বিপ্লব, স্ট্যালিন বিপ্লব, হিরোশিমা নাগাসাকি, এপ্রিল ফুল দিবসের সাথে ২৮ আক্টোবর ও এই ট্রিিজডি হিসেবে সংযুক্ত হয়েছে। বিশ্বযুদ্ধ, ক্রুসেড চায়না বিপ্লব, বোসনিয়া/চেচনিয়া, ইরাক, আফগানিস্থান,ফিলিস্তিন,মিয়ারমার,কাশ্মীর,সহ বিশ্বেও বিভিন্ন স্থানে মুসলিম গণহত্যা ও নির্যাত নের ধারাবাহিক অংশ। হিটলার, মুসোলিনী, চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, তৈমুর লং, কুবসাই খান, খেসারু হত্যা এবং মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম গণহত্যা,কাশ্মীরের রক্তাক্ত ঘটনা দুনিয়াবাসীর স্মৃতিতে বীভৎস চিত্রের মত ২৮ আক্টোবর ও ভেসে ওঠে আজো।
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরে পল্টনে আওয়ামী লীগ লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যার দৃশ্য স্মরণ করলে এখনো শিউরে উঠে মানুষের শরীর, বাকরুদ্ধ হয় বিবেক। পৈশাচিক ও অমানবিকভাবে মানুষ হত্যার দৃশ্য এখনো কাঁদায় সকলকে। বিশ্বমানবতা শতাব্দীর পর শতাব্দী খুনীদের প্রতি ঘৃনা ও অভিশাপ দিতে থাকবে। ২৮ অক্টোবর আওয়ামী জঙ্গিপনার এক রক্তাক্ত দলীল হিসেবে ইতিহাসে চিন্হিত হয়ে থাকবে। Britannica R.R. ENCYCLOPEDIA-তে বলা হয়েছে-Terrorism Systematic use of violence to create a general climate of fear in a population and thereby to bring about a particular political objective.
আজ থেকে প্রায় ১৪ বছর আগে কথা। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র পল্টন ময়দানে আওয়ামী-বামরা প্রকাশ্য দিবালোকে লগি-বৈঠা দিয়ে যে পৈশাচিক কায়দায় জীবন্ত মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করার পর লাশের উপর নৃত্য করেছে তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল! ২৮ অক্টোবর এটি একটি কালো অধ্যায়ের দিন। একটি কলঙ্কের সংযোজনের দিন। এ দিন মানবাধিকার ভুলন্ঠিত দিবস, লগি-বৈঠার তান্ডব দিবস, আওয়ামী বর্বরতার দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। আওয়ামীলীগ ২৮ আক্টোবরের মত অনেক ঘটনা দেশে ঘটিয়েছে তা বর্নানা কওে শেষ করা যাবেনা।
২৮ আক্টোবরের হামলা চালানো হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। দেশের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রেও অংশ হিসেবে অত্যান্ত ঠান্ডা মাথায় এ জমিন থেকে ইসলামী আন্দোলন নিশ্চিন্হ করে ও নেতৃত্বকে হত্যা করাই ছিল উদ্দেশ্য। সে ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম, সাবেক আমীর ও মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী,আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, মীর কাশেম আলী, আব্দুল কাদেও মোল্লা কে ফাঁসি দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় করেছে। অধাপক গোলাম আযম, মাওলানা এ কে এম ইউসুফ, মাও: আবদুস সোবহান (সাবেক এম পি) সহ তিনজন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্টে জুলুমের শিকার হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। ২৮ অক্টোবর মানবতার বিরুদ্ধে যে জঘন্য ইতিহাস দিয়ে আওয়ামীলীগ-বামরা যাত্রা শুরু করেছে, অপরাধের মাত্রা দিন দিন ভয়ংকর রূপ আজ আইয়্যামে জাহিলিয়াতকেও হার মানাতে বসছে।
২৮ অক্টোবর সেদিন ঘটনার শুরু যেভাবে-
আজ থেকে তের বছর আগের কথা। ২৮ আক্টোরর ২০০৬ ছিল চারদলীয় জোট সরকারের ক্ষমতার ৫ বছর বর্ষপূর্তির দিন। ক্ষমতা হস্তান্তরের এই দিনে বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে আয়োজন করা হয়েছে জনসভার। মুলত ২৭ আক্টোরর থেকেই সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে ১৮ জনকে হত্যা করে। ২৮ অক্টেবর সকাল ১০টায় আমরা ইসলামী ছাত্রশিবিরের পল্টনস্ত কেন্দ্র্রীয় কার্যালয়ে উপস্থিত। হঠাৎ গেটের সামনে চিৎকার। বেরিয়ে দেখি একজন ভাইকে রিকশায় করে রক্তাক্ত অবস্থায় নিয়ে আসা হচ্ছে তার মাথায় এমনভাবে আঘাত করা হয়েছে মাথার এক পাশ ঝুলছে! দেখে শরীর শিহরে উঠছে!।
পণ্টন রাধুনির গলিতে আমরা একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখি গলির একটু ভেতরে পড়ে আছে আমাদের প্রিয় ভাই শহীদ মুজাহিদের লাশ। তার দেহ এখন নিথর নিস্তব্ধ। তিনি শাহাদাতের অমিয় সূধা পান করে পাড়ি জমিয়েছেন তার কাংখিত মঞ্জিলে। শাহাদাতের মৃত্যুর জন্য মুজাহিদ প্রায় তার মায়ের কাছে দোয়া চাইতেন। মাবুদ আজ তার আকাঙ্খা পূর্ণ করেছেন,আলহামদুলিল্লাহ।
শহীদ মুজাহিদ তাঁর মাকে বলত, “মাগো বেশি বেশি কুরআন পড়ো, তাফসির সহকারে, আমল করার লক্ষ্যে কুরআনকে হৃদয়ে ধারণ করো। সে রেগুলার তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তো, নফল রোজাও রাখতো। মাগো, শহীদ হতে চাইলেই কি শহীদ হওয়া যায়? যায় না মা। শহীদ হতে হলে অনেক বড় ভাগ্য লাগে, সত্যিকারার্থে আমার কি সেই ভাগ্য আছে মা, শহীদ হলে কর্মফলের কোন হিসাব দিতে হয় না, কোন শাস্তি হয় না কবরে, জাহান্নামে যেতে হয় না। শাহাদাত হলে সরাসরি জান্নাতে যাওয়া যায়”।
হায়েনারা আমাদের প্রিয় ভাই শহীদ মুজাহিদকে হত্যার পর গলির মধ্যে ফেলে রেখেছে । আমাদেও ভাইয়েরা কয়েকজন মিলে যখন কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে তার মৃতদেহ। কিন্তু রক্তপিপাসু আওয়ামী সন্ত্রাসীদের রক্তের পিপাসা তখনও থামেনি। লাশের ওপর তারা ছুড়ে মারছে ইট, পাথর, বোতল ও লাঠি। আল্লাহর প্রিয় বান্দা শহীদ মুজাহিদ শাহদাতের অমিয় সুধা পান কওে বিদায় নিয়েছেন। আল্লাহর জান্নাতের মেহমান হিসেবে তাকে কবুল করেছেন। আমি হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে শুনলাম প্রিয় ভাই মুজাহিদ আর নেই। তখন স্মৃতিতে ভেসে উঠলো সব ঘটনা।
এ পর্যায়ে দীর্ঘ ৫/৬ ঘণ্টা পর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের পিস্তলের গুলি আমার বাম পায়ে আঘাত হানল। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। গাড়ির চাকা পাংচার হওয়ার মতো জমিনে লুটিয়ে পড়লাম। দীর্ঘ ৭ ঘণ্টা যাদের সাথে আমরা মোকাবেলা করেছি, কী তাদের পরিচয়? তারা আওয়ামী লীগ ভাড়াটে সন্ত্রাসী, টোকাই, গার্মেন্টস কর্মী ও হিন্দার মত লোকদের নিয়ে এসেছে। মুখে রুমাল, কোমরে মাফলার, খালি গায়ে মারামারিতে অংশ নিয়েছে ওরা। কোন ভালো ঘরের সন্তান কি এখানে ছিলো? ২৮ অক্টোবর বিশ্বের মানুষ চিনতে সক্ষম হয়েছে উগ্র ও জঙ্গি কারা। কিন্তু আজও ভাবি আওয়ামীলীগ আর কত সন্ত্রাস, খুন, গুম করলে তাদের জঙ্গি বলা হবে? এই স্বৈরাচারী জংগী শাসন আর কত দিন চলবে?
এ সবের মাঝে পল্টনে এ জাতি আরেকবার দেখে নিয়েছে আমাদের পরীক্ষিত নেতৃত্ব। শ্রদ্ধেয় আমীরে জামায়াত সাবেক সফল মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের সহসী নেতৃত্ব। মুহুর্মুহু গুলি আর বোমা স্তব্ধ করতে পারেনি তার বলিষ্ঠ কণ্ঠকে। সেদিন তাঁর বক্তব্য ছিল তেজোদীপ্ত, নিশ্চল, অবিরত আর অবিচল। তিনি যেন মাওলানা মওদূদীর অবিকল প্রতচ্ছবি। সেদিন শহীদ নিজামী সহ ষ্টেজে শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে রক্ষা করতে শহীদেরা জীবন দিয়েছে কিন্তু মাথা নত করেিেন। কিন্তু সেই নেতৃবৃন্দ অনেকেই আজ নিজেই শাদাদাতের অমিয় সুধা পান করে চলে গেছেন মহান মাবুদেও দরবারে।
২৮ অক্টেরব নিয়ে লাভ-ক্ষতির নিরন্তন হিসেব চলছে রাজনীতে এখনো—। কিন্তু শহীদ পরিবারের অনুভূতিতো ভিন্ন!। কিন্তু তা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য!। শহীদ ফয়সালের মায়ের অনুভূতি- “সেই ভয়াবহ ২৮ অক্টোবর সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্যটা ভুলার মত নয়, ফয়সালকে হারিয়ে আর স্ব^াভাবিক জীবনে ফিরে আসা ‘মা’ হয়ে আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সে ছিল খুবই নরম স্বভাবের। এমন ছেলেকে লগি-বৈঠা দিয়ে জীবনে শেষ করে ফেলা এটা মানুষের কাজ নয়, এরা নরপশু, ওদের মায়ামমতার লেশমাত্র নেই। আল্লাহর পছন্দনীয় সবদিক থেকে সুন্দর বান্দাটিকেই তার কাছে নিয়ে গেলেন। শহীদদের স্বভাবটা এরকমই হয়ে থাকে। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন ওদেরকে শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন”।
শহীদ হাফেজ গোলাম কিবরিয়া শিপন মা বলেন-”সে দাখিলে ১১তম স্থান অধিকার করে। মানুষের যেকোন বিপদ কিংবা সমস্যা সমাধানে সে দ্রæত সাড়া দিত। এক ছেলের অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা উঠলে তাকে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তির পর দেখা গেল তার ওষুধের টাকা নেই। সে তার নিজের পকেটের টাকা দিয়ে ঐ ছেলের ওষুধ কিনে দেয় এবং সারারাত তার বিছানার পাশে থেকে শুশ্রƒষা প্রদান করে ভোরে পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরে। এলাকার এক বৃদ্ধ লোকের কাছ থেকে ছিনতাইকারীরা টাকা পয়সা ছিনিয়ে নিলে ঐ লোকটিকে ৩০ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে তার নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। সরকারি বিজ্ঞান কলেজে অর্থ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে তার আচরণে মুগ্ধ হয়ে হিন্দু ছেলেরা পর্যন্ত বায়তুলমালে অর্থ প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করত। শিপন এলাকার অনেক ছেলেকে কুরআন শরিফ পড়তে শিখিয়েছে।
এলাকার ছেলেরা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তাদেরকে ভাল করতে হবে এই চিন্তায় সে সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিল। সে সবাইকে মসজিদে নামাজ এবং কুরআনের আলোকে জীবন গড়ার তাগিদ দিতে ব্যতিক্রম আয়োজনের মাধ্যমে তাদেরকে দাওয়াত পৌঁছাতো। যেমন- ব্যায়াম, ফুটবল, ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন। ফজরের নামাজের সময় ছেলেদেরকে নামাজের জন্য ডাকতো।
আমার শিপনকে যেরকম নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে শহীদ করা হয়েছে আমার ছেলে কুরআনে হাফেজকে তারা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার দাঁত পর্যন্ত শহীদ করেছে- তাই আমি এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি চাই এবং ভবিষ্যতে আর কোনো মায়ের বুক যেন এভাবে খালি না হয় এবং কোন সন্তানকে যেন এভাবে না মারা হয়”।
শহীদ রফিকুল ইসলাম-এর মা বলেন-”রফিকুল শিবির করার পর থেকেই নামাজ পড়তে বলত, গ্রামের মানুষ ঝগড়া করলে সে আমাদের সেখান থেকে দূরে থাকতে বলত। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর খাওয়া শেষ করে রফিকুল যখন চলে যাচ্ছে তখন ওর খালা ও আমি বাড়ি থেকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলাম। কে জানত যে, সেটাই তার শেষ দেখা?
আমার ছেলেকে হারানোর দু-একদিন পর এক রাতে ঘুমের মাঝে আমার ছেলে আমার সাথে দেখা করতে এলো। আমি তার সাথে কথা বললাম। আমি বললাম ‘তুই না মরে গেছিস?’ সে বলল- ‘আম্মা, এ কথা আর কখনো তুমি বলবে না। আমি মরে যাইনি, আমি শহীদ হয়েছি।’
হ্যাঁ সে ইসলামের জন্যই শহীদ হয়েছে, আর আমি তার গর্বিত মা। আমার ছেলের কোন অপরাধ ছিল না। সে এলাকার ছেলেদের কুরআন শেখাতো, নামাজ পড়াতো। এতো সুন্দর সোনার টুুুুুুকরো ছেলেকে যে আওয়ামী হায়েনারা আঘাতের পর আঘাতে আমার বুক খালি করিয়েছে আমি তাদের বিচারের অপেক্ষায় আছি। যদি দুনিয়ায় দেখে যেতে নাও পারি তবে অবশ্যবই সবচেয়ে বড় ন্যায়বিচারক মহান আল্লাহর দরবারে বিচার দেখবো ইনশাআল্লাহ।
শহীদ মাসুমের মায়ের অনুভূতি এমন- “মাসুম লেখাপড়ার পাশাপাশি কুরআন-হাদিসের চর্চা করে এবং আমল করে। ছাত্রশিবিরের একজন ছাত্রকে পিতামাতার চক্ষুশীতলকারী সন্তান হিসেবে সমাজে উপহার দেয়। অভাবীদের ও গরিব ছাত্রের ভর্তির টাকার ব্যবস্থা করে নিজের প্রিয় পছন্দের জামাটি পরিয়ে দিয়ে তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল শহীদ মাসুম।
লেখাপড়ায়ও মেধাবী ছিল। মতিঝিল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসিতে প্রথম বিভাগ ৩টি লেটারসহ ও বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে এইএসসি পাস করে ইংলিশে অনার্সে ভর্তি হয়েছিল। আওয়ামী-সন্ত্রাসীরা তাকে মেরে ফেলল এ কথাটি এখনো এলাকাবাসী সহ্য করতে পারছে না। আল্লাহর কাছে চলে যাওয়ার পর এখন বুঝি কী সম্পদ হারিয়েছি। ওকে আমি একটি মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারি না। সেই মাসুমকে ছাড়া আমি চোখের পানিকে সাথী করে বেঁচে আছি। সব আছে মাসুম নেই।
আমাদের সন্তানরা নিহত হয়েছে তার সোনার ছেলেদের লগি-বৈঠার আঘাতে। আওয়ামী লীগ কোনভাবে অস্বীকার করতে পারবে না। তিনি বলেছিলেন, লগি-বৈঠা, ঢল নিয়ে আস।’আল্লাপাক অবশ্যই তার বিচার করবেন। এই জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই আমরা শহীদের মা হতে পেরেছি। আল্লাহর পথে বাঁধা দিতে গিয়ে তারাই ধ্বংসের অতল গহŸরে তলিয়ে যাবে ফেরাউন ও নমরূদের মত। এই আটাশে অক্টোবরে নতুন করে শহীদদের আত্মদানের কথা স্মরণ করে আমাদের দ্বীন কায়েমের পথ চলা হোক আরো বেগবান।”
শহীদেরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েও তারা যেন অমর!। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে নিজের মেহমান হিসেবে জান্নাতে থাকতে দেন। আল্লাহ বলেন, “আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের মৃত মনে করো না, প্রকৃত পক্ষে তারা জীবন্ত, কিন্তু তাদের জীবন সম্পর্কে তোমরা অনুভব করতে পারো না” (২: ১৫৪)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, “তাদের প্রাণ সবুজ পাখির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। আল্লাহর আরশের সাথে ঝুলন্ত রয়েছে তাদের আবাস, ভ্রমণ করে বেড়ায় তারা গোটা জান্নাত, অত:পর ফিরে আসে আবার নিজ নিজ আবাসে।” (মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ) প্রিয় রাসুল (সা) বলেছেন: ‘‘শাহাদাত লাভকারী ব্যক্তি নিহত হবার কষ্ট অনুভব করে না। তবে তোমাদের কেউ পিঁপড়ার কামড়ে যতটুকু কষ্ট অনুভব করে, কেবল ততটুকুই অনুভব করে মাত্র।” (তিরমিযী)
বাংলার জমিনে প্রতিটি মুহুর্তে আজ শাহাদাতের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। সন্তান হারা পিতা-মাতার আহাজারি, ভাই হারা বোনের আর্তনাদ, পিতা হারা সন্তানের করুন চাহনী, মা হারা সন্তানের অব্যক্ত বেদনা বাংলার আকাশ বাতাসকে প্রকম্পিত করছে। এবার শাহীদের তালিকায় যোগ হচ্ছে সমাজের শ্রেণী পেশার মানুষ। হক ও বাতিলের এই দ্বন্দ্ব কোন সাময়িক বিষয় নয়, এটি চিরস্থায়ী শাহাদাত ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবের সিঁড়ি, কর্মীদের প্রেরণার বাতিঘর, উজ্জীবনী শক্তি, নতুন করে পথচলার সাহস।
২৮ অক্টোবর পল্টনে শাহাদাতের নজরানার মধ্য দিয়ে রাজপথে যে যাত্রা শুরু হয়েছে সে জমিন রক্ত ও স্মৃতি বিজরিত এ জমিনে বিজয়ের সূচনা করবে ইনশাআল্লাহ। হে বিস্তীর্ণ আকাশ ও জমিনের মালিক! তুমি সকল শহীদদের শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান কর, আমাদের ফরিয়াদকে কবুল কর। হে আল্লাহ! তুমি সকল ত্যাগের বিনিময়ে বাংলার জমিনে দ্বীন কায়েমের তাওফিক দাও। শহীদেরকে শাহাদাতের উচ্চ মাকাম দান করো,আমাদেও সেই পথে কবুল কওে জান্নাতে মিলিত হবার তাওফিক দাও,আমীন।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা।