পবিত্র মাহে রমাদানে মুসলমানদের প্রথম কেবলা মসজিদে আকসায় নামাজরত মুসল্লিদের ওপর ইসরাইলি সেনাদের নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা ও অমানবিকতা গোটা পৃথিবীবাসিকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।
অথচ আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দ’শ বছর আগেই মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তাআলা তাদের সম্পর্কে বলেছেন, ঈমানদারদের সাথে শত্রুতার ক্ষেত্রে তুমি ইহুদী ও মুশরিকদের পাবে সবচেয়ে বেশী উগ্র৷ (সূরা মায়েদঃ ৮২)
গাজায় গত সোমবার থেকে যে ভয়াবহ মাত্রায় বিমান হামলা ইসরাইল করছে তার নজির বিরল। ইসরাইলের সেনাবাহিনীর দেয়া হিসাবেই শনিবার পর্যন্ত গাজার ৬৫০টি টার্গেটে বিমান হামলা হয়েছে। অর্থাৎ সোমবার থেকে গড়ে প্রতিদিন একশ থেকে দেড়শ বার ইসরায়েলী যুদ্ধ বিমান গাজায় উড়ে গিয়ে বোমা ফেলছে। সেইসাথে চলছে সীমান্ত থেকে দূরপাল্লার কামানের গোলা।
গাজায় বিবিসির এক সংবাদদাতা বলেছেন, বহু ইসরাইলি হামলার প্রত্যক্ষদর্শী তিনি, কিন্তু এমন ভয়ঙ্কর হামলা আগে দেখেননি। রুশদি আবু লাউফ টুইট করেছেন, গাজার সর্বত্র বিস্ফোরণ হচ্ছে। কোথায় বোমা পড়লো যোগাযোগ করে তার খোঁজ নেওয়া আর সম্ভব হচ্ছে না।
গাজায় স্বাস্থ্য বিভাগের দেয়া হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় দু’শর কাছাকাছি যার মধ্যে ৫২টি শিশু। ফলে গাজার মতো অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ একটি এলাকায় নির্বিচারে বোমা হামলা নিয়ে জাতিসঙ্ঘসহ বহু দেশ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
কিন্তু এখনও এসব নিয়ে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ইসরাইলের। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এখনো বলছেন, ‘যতদিন প্রয়োজন গাজায় বিমান হামলা চলবে।’ এমনকি গাজায় স্থলবাহিনী ঢোকানোর সম্ভাবনাও নাকচ করছে না ইসরাইল। প্রশ্ন হচ্ছে, ঠিক কোন প্রয়োজনের কথা বলছেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী? গাজায় এ দফার এই সামরিক অভিযান থেকে কোন উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাইছে ইসরাইল?
ইসরাইলের নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা সংস্থা জেরুজালেম ইন্সটিটিউট অব স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড সিকিউরিটি‘র (জেআইএসএস) গবেষক ড. জনাথন স্পায়ার বিবিসি বাংলাকে বলেন, হামাসের ছোড়া রকেটের জবাব দিচ্ছে ইসরাইল এবং এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে যাতে হামাস ভবিষ্যতে এমন সাহস না দেখায়।
হামাস গত সাতদিনে গাজা থেকে তেলআবিবসহ ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে প্রায় তিন হাজারের মত রকেট ছোঁড়া হয়েছে। যার আঘাতে মারা গেছে দশজন। রোববার ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে তারা গাজায় হামাসের শীর্ষ নেতা ইয়াহইয়া সিনওয়ারকে টার্গেট করে এবং তার বাড়িতে বোমা হামলা চালানো হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, গত কয়েকদিনে হামাসের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন নেতা মারা গেছেন।
ড. স্পায়ার বলেন, হামাসকে সরিয়ে দিলে গাজায় নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাবে তা নিয়ে ইসরাইল উদ্বিগ্ন। ইসরাইল নিজে আবারো গাজার সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নিতে কোনোভাবেই চায় না। অনেক পর্যবেক্ষকই বিশ্বাস করেন, হামাসকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া ইসরাইলের রাজনৈতিক স্বার্থেরও পরিপন্থী, কারণ হামাসের কারণেই ফিলিস্তিনিরা রাজনৈতিকভাবে এবং ভৌগোলিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত রয়েছে যা রাজনৈতিকভাবে ইসরাইলকে সুবিধা দিচ্ছে।
২০০২ সালে ফিলিস্তিনীদের দ্বিতীয় ইন্তিফাদা, ২০০৬ সালে হিজবুল্লার সাথে যুদ্ধ এবং ২০০৬ এবং ২০০৮ সালে গাজায় হামাসের সাথে লড়াইয়ের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে ২০১৩ সালে তার এক গবেষণাপত্রে অধ্যাপক ইনবার লেখেন- “ইসরায়েল মেনে নিয়েছে এসব সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে তাদের লড়াই হবে দীর্ঘ ও জটিল। সাময়িক শক্তি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ ও নিশ্চিত বিজয় সম্ভব নয়।
ড স্পায়ার বলেন, ‘এই দফার এই সংঘাতে যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তা হলো হামাস এই প্রথম ইসরাইলের ভেতর আরব জনগোষ্ঠীকে খেপিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এটি এবার হামাসের বড় একটি কৌশলগত অর্জন এবং ইসরাইলের বড় মাথাব্যথার কারণ।’ তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ এই পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করতেই ইসরাইল হয়তো এখন যত দ্রুত সম্ভব গাজায় অভিযান বন্ধের তাড়না অনুভব করছে। (সূত্র : বিবিসি)
ইহুদীরা হচ্ছে আল্লাহর অভিশপ্ত জাতি। বনী ইসরাইলদেরকে আল্লাহ তা’য়ালা সম্মান দিয়েছিলেন যখন তারা বিশ্বাসী বা মুমিন ছিলো। ছিলো পয়গম্বরদের অনুগত এবং নাজিলকৃত শিক্ষার বাহক। তারা কুটিল পন্থায় জটিলভাবে জড়িয়ে পড়ে। তারা ইব্রাহীম (আঃ) যোসেফ এবং মূসা (আ:) এর পবিত্র শিক্ষাকে মিথ্যায় কলুষিত করেছে। অসংখ্য পয়গম্বরকে হত্যা করেছে। সন্ত্রাস এবং কলুষতা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছে এবং ছলনা ও সুদীকারবার ব্যবস্থায় মানুষদেরকে তাদের ধন সম্পদ থেকে বঞ্চিত করেছে। অসংখ্য নবীর স্মৃতিধন্য ও মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাস-এর পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিন আজ ইহুদীদের কবজায়।
১৯১৪ সালে শুরু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মুসলমান শাসকদের অদূরদর্শিতা এবং ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রের কারণে তুরস্কে মুসলিম খিলাফত ভেঙ্গে যায়। শুধু তাই নয় ব্রিটিশ বাহিনী ১৯১৭ সালে ইরাক, সিনাই উপত্যকা, ফিলিস্তিন ও পবিত্র জেরুজালেম দখল করে নেয়। তারা ফিলিস্তিন বিজয়ী বীর সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর মাযার শরীফ-এ পদাঘাত করে উচ্চস্বরে বলতে থাকে “হে সালাহ উদ্দিন উঠে দেখ আমরা তোর সিরিয়া জয় করে এসেছি”। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিনসহ বেশিরভাগ আরব এলাকা চলে যায় ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের দখলে। পৃথিবীর কোন দেশ তাদের ভূখন্ডে ইহুদীদের বসাতে রাজী হয়নি। শেষ পর্যন্ত বেলফোর ঘোষণা অনুযায়ী ফিলিস্তিন এলাকায় ইহুদিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
মূলত মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদ কুক্ষিগত করা ও বিভিন্ন স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখার প্রয়োজনেই এই সন্ত্রাসী রাষ্ট্রকে লালন করা হচ্ছে। ইসরাইলের বর্তমান জনসংখ্যা ৭৪ লক্ষ ৬৫ হাজার। আমেরিকার মদদে ইসরাইল এখন এতটাই শক্তিশালী যে, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের রয়েছে একচ্ছত্র আধিপত্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেদিন খুব বেশী দূরে নয় যেদিন বিশ্ব মানচিত্র থেকে ইসরাইলের নাম আবার মুছে যাবে। রাসূল (সাঃ) সেই ভবিষ্যদ্বাণীই করেছেন ইহুদীদের সম্পর্কে। তবে সেটির জন্য দরকার মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ও মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে একতা। গোটা মুসলিম এখনো নিরব থাকা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য।
মূলতঃ ইহুদী চক্র গোটা পৃথিবীর মুসলমানদের বিভক্ত করে রেখেছে। এ জন্যই মুসলমানরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছেনা। অশিক্ষা, দারিদ্র্য, অনৈক্য সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে এই বীরের জাতি। অথচ মুসলমানদের ইতিহাস অনেক গৌরবের সাফল্যমন্ডিত। মুসলমানরা আজ যেন সব হারাতে বসেছে।
কিন্তু ইহুদীরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে পূর্বসূরীদের নির্দেশনা। ইসরাইলী সাবেক মন্ত্রী ইজাক রবিনের The Robin Memoirs নামক আত্মজীবনীতে লিখেন- ১৯৪৮ সনে যখন ইসরাইলী সেনারা ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে ছলনা করে অবৈধ ইসরাইলী রাষ্ট্র গঠন করছিল। সে সময়ে রবিন একজন ২৬ বছর বয়সী তরুণ ব্রিগেড কমান্ডার হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তিনি স্বীকার করে বলেন, তখন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেনগুড়িয়ান তাকে তেল আবিবের নিকটবর্তী দুটি শহর থেকে ৫০,০০০ আরব অধিবাসীকে শক্তি প্রয়োগ করে তাড়িয়ে দিতে আদেশ দেন। News Week, Nov ৫, ১৯৭৯)
বিশ্ব-ইহুদীদের কাছে নেপোলিয়নের আহ্বানটি এখনো অনুকরনীয় নির্দেশনা হিসেবে তারা পালন করছে- হে ইসরাইলীগণ! হে ‘তীহ’ প্রান্তরে বিতাড়িতগণ! শক্তির সাথে জাগ্রত হও! তোমাদের সামনে এখন তোমাদের জাতির জন্য এক ভয়াবহ যুদ্ধ অপেক্ষা করছে! দ্রুত অগ্রসর হও, এই তো সময়-এমন সুবর্ণ সময় হয়তো হাজার বছরেও আর ফিরে আসবে না। যে অধিকার হাজার হাজার বছর ধরে তোমাদের থেকে হরণ করা হয়েছে তা হচ্ছে- বিভিন্ন জাতির মধ্যে একটি জাতি হিসেবে তোমাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব এবং তোমাদের প্রভু ‘ইয়াহুয়াহ’কে তোমাদের বিশ্বাস অনুযায়ী উপাসনা করার নিরঙ্কুশ সহজাত অধিকার। তা তোমরা প্রকাশ্যে কর, চিরদিন কর! বোনাপার্ট ইহুদীদের প্রভুত্ব ব্যঞ্জক আচরণের শেষ কোথায়?
বর্তমান সময়ে ইহুদী আগ্রাসীরা নিজেদেরকে অতীতের যেকোন উচ্চাকাংখী রাজা বা দেশের চাইতেও বেশি শক্তিশালী, ধন সম্পদশালী এবং চতুরতায় পারদর্শী বলে মনে করে। তারা তাদেরকে সারা দুনিয়া এবং মানবজাতির প্রভু বলে বিবেচনা করে। মানব জাতির বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু যেমন প্রযুক্তি বিদ্যা, সমরাস্ত্র, অর্থ, খাদ্য, ঔষধপত্রসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি তাদের হাতে বা দখলে আছে বলে তারা দাবি করে।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, ইসরাইল একদিন আমেরিকাসহ গোটা বিশ্বের জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়াবে সেদিন বেশি দুরে নয়। CBS টেলিভিশনের Face The Nation অনুষ্ঠানে ১৯৭৩ সনে সিনেটর উইলিয়াম ফুলব্রাইট ঘোষণা দেন যে, সিনেট হচ্ছে- আমেরিকান স্বার্থের পরিপন্থি ইসরায়েলী স্বার্থের অধীনস্ত সহায়ক কেনা গোলাম। সিনেটর জেমস জি আবরেজক বলেন : “যুক্তরাষ্ট্র যদি আগে নাও হয়ে থাকে- তবে একটি অধীন রাষ্ট্রের কাছে বন্দী হতে যাচ্ছে- অর্থাৎ ইসরাইলের অধীন হতে যাচ্ছে।”
১৯৪৮ সালের পর থেকে ফিলিস্তিনীদের দু’বারেরই লড়াই ছিল আত্মরক্ষামুলক, একবার সফল হয়েছিল, অন্যবার সফল হয়নি। এ লড়াইয়ে ফিলিস্তিন জাতি উপহার দিয়েছে -২,৬১,০০০ জন শহীদ, ১,৮৬,০০০ জন আহত, ১,৬১,০০০ জন পঙ্গু। এছাড়া প্রায় দু’মিলিয়ন ফিলিস্তিনী স্বদেশ ছেড়ে বাইরে যেতে বাধ্য হয় এবং তাদের পরিবারবর্গসহ শরণার্থীতে পরিণত হয়। সে দু’মিলিয়ন দেশ ছাড়া লোক এখন ৫ মিলিয়নে পৌঁছে গেছে। সঠিক সংখ্যা হচ্ছে ৫ মিলিয়ন ৪ লক্ষ। এবারের লড়াইয়ে ত্যাগ-কুরবানীর পাহাড় অনেক দীর্ঘ হলেও আল্লাহ মুমিনদের সাহায্য কিভাবে করেন তার নজীর বিশ্ববাসী আবার ফিলিস্তিনের গাজায় দেখেছে।
ফিলিস্তিন এখন মুসলিম শিশু, নারী-পুরুষের রক্তে রঞ্জিত এক জনপথ। আজ ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ঘরে-ঘরে সন্তান হারানোর বেদনা আর আহাজারী। কাঁদতে কাঁদতে এখন যেন চোখে পানিও নেই। শোকের পাহাড় বয়ে চলছে প্রতিটি পরিবারে। রক্তপিপাসু ইসরাইলের মুল লক্ষ্য এবার মুসলমানদের পরবর্তী প্রজন্মকে নি:শেষ করে দেয়া। নিহতের বেশীর ভাগই শিশু। ফেরাউন মুসা (আ:) এর আগমন ঠেকাতে সব ছেলে সন্তানকে হত্যা করলেও আল্লাহ তা’য়ালা তার ঘরেই মুসা (আ:)-কে লালন পালন করানোর ব্যবস্থা করলেন। সুতরাং ইসরাইলের এই নীতিও বুমেরাং হবে। পৃথিবীর কোন যুদ্ধ আইনে নারী-শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করা সমর্থন করেনা। ইসরাইলের সন্ত্রাসীরা আজ সেই জঘন্য কাজটি করছে। রাস্তার পাশে লাশের সারি! সর্বত্র মানুষের খন্ড বিখন্ড শরীরের টুকরা। রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে সব জায়গায়! কোথায় তাদের বাড়ি-ঘর! কোথায় তাদের ঠিকানা! স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদ, হাসপাতাল সব জায়গায় চলছে অব্যাহত হামলা। পৃথিবীতে হাসপাতালগুলোতে আক্রমণ যুদ্ধরীতি বিরুদ্ধ হলেও কোন আইন, নীতি, মানবিকতা কোন কিছুরই তোয়াক্কা করছেনা ইসরাইল।
ইসরাইলের বার-ইলান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোরদেচাই কেদর ইসরাইলী সৈন্যদের গাজায় “ধর্ষণ-অস্ত্র প্রয়োগের পরামর্শ দিয়ে সারা বিশ্বে তাদের নোংরা চরিত্রের উম্মেষ ঘটালেন। ইহুদীরা এ যেন রক্তের হলি খেলায় লিপ্ত! এ হচ্ছে মানবিকতার বিরুদ্ধে ইসরাইলের সবচেয়ে বড় আঘাত। এ কোন অসম যুদ্ধ!! এতো কোন যুদ্ধ নয় এ হচ্ছে গণহত্যা। এ যেন মাছুম শিশুদের জীবন নিয়ে প্রচন্ড তামাশা! এত অমানবিক নির্যাতন গাজায় চলছে তা মুসলিম বিশ্ব দেখেও যেন না দেখার ভান করছে। প্রতিটি নারকীয় তান্ডবের পর দু’একটি বিবৃতি আর বিক্ষোভ ছাড়া কার্যকর কোন তৎপরতা এখনো পরিলক্ষিত হয়নি। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও জোরালো কোন প্রতিবাদ এখনও করেনি। সবাই যেন রুটিন মাফিক প্রতিবাদই করছে। আরব বিশ্ব অনেকটাই নীরব। দু’একটি দেশ ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বিবৃতি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রেখেছে। হামলা বন্ধে যারা কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার কথা সেই মিসরে এখন আমেরিকা-ইসরাইল পুতুল সিসি সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত।
মূলত মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা-ইসরাইল নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। এটা এখন দিবালোকের মত পরিষ্কার। বিশ্বের মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা গাজায় এই অমানবিক নিষ্ঠুরতাকে যেন উপভোগ করছে। এত কিছুর পরও মুসলমানদের দৃঢ়তা ও আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল ছিল অভাবনীয়। ফিলিস্তিনের সাবেক নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ও হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া বলেছেন, গাজা হবে ইসরাইলিদের কবরস্থান। গাজায় আগ্রাসন ও গণহত্যার মাধ্যমে ইসরাইলের আসল চেহারা উন্মোচিত হয়েছে। তবে শত বাধা ও ইসরাইলের বারবার আগ্রাসন সত্ত্বেও ফিলিস্তিনীদের তাদের সংগ্রামের পথ থেকে সরানো যায়নি।
ইসরাইলী বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে গাজার নিরপরাধ মানুষের আর্তচিৎকারে পৃথিবী যখন কাঁদছে সেই আর্তচিৎকার শুধু পৌঁছেনি বিশ্বের মোড়লদের কানে। ইসরাইলী বর্বরতা ও নিষ্ঠুর নির্যাতন থেকে নিরপরাধ এবং নিরস্ত্র মুসলমানদেরকে বাঁচানোর জন্য বিশ্বনেতাদের কেউই এগিয়ে আসছে না এখনো।
আরব রাষ্ট্রগুলো প্রতিবাদের পরিবর্তে যেন হামলার যোগানদাতা। গাজা ইস্যুতে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হয়েছে তথাকথিত মুসলিম রাষ্ট্র নায়কদের। যারা নিজেদের গদী রক্ষায় ইহুদীদের জুলুম নির্যাতনের প্রতিবাদ করেনি। মহান আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছে- “তোমরা কি একথা মনে করে রেখেছো যে তোমাদের এমনিই ছেড়ে দেয়া হবে? অথচ আল্লাহ এখনো দেখেননি তোমাদের মধ্য থেকে কারা (তাঁর পথে) সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালালো এবং আল্লাহ, রাসূল ও মুমিনদের ছাড়া কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না? তোমরা যা কিছু করো, আল্লাহ তা’য়ালা তা জানেন।”
আজ ফিলিস্তিনে মুসলমান হত্যায় বিশ্ব যতই নীরব থাকুক। হয়ত সেদিন বেশী দুরে নয়, যেদিন ইসরাইল হুমকি হয়ে দাঁড়াবে, গোটা পৃথিবীর জন্য। তাই এখনই মুসলিম উম্মাহকে ইহুদীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সোচ্চার হতে হবে মুসলমানদের পবিত্র ভূমি পুনরুদ্ধার সংগ্রামে। আল্লাহ তা’য়ালা মজলুমের সহায় হোন।
২০১৪ সালে অনেকটাই নাকানি-চুবানী খেয়েছে হামাসের কাছে। তখন ইসরাইল সৈন্যদের আত্মহত্যা, যুদ্ধে মনোবল হারানো এবং হামাসের রণকৌশলের কাছে হয়েছে ধারাশায়ী। এই অসম যুদ্ধে শিশু এবং বেসামরিক লোক হত্যা করে বিশ্ব দরবারে ইসরাইল অপমানজনক পরাজয় ছাড়া হয়ত আর কিছুই অর্জন করতে পারবেনা। ইসরাইল এর আগে এমনই ভয় পেয়েছে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার আশ-পাশের এলাকায় বসবাসকারী দখলদার ইহুদীদের ৭৫ শতাংশই তাদের বাড়ি ঘর ছেড়ে পালিয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে সেই শহরের জেলা কাউন্সিলের প্রধান হাইম ইয়েলিন। (খবর প্রেস টিভি)। বিপরীত দিকে যুদ্ধে ফিলিস্তিনীদের অনড় মনোবল, শাহাদাতের তামান্না, যুদ্ধের রণকৌশল গোটা বিশ্বকে অবাক করেছে।
ফিলিস্তিনীদের মূলমন্ত্র হলো ‘শাহাদাতের ইচ্ছাতেই জীবন পেত পার।’ মহান লিবীয় মুজাহিদ ওমর আল-মুখতার বলেছিলেন, ‘আমি আমার স্বাধীনতার অধিকার, আমার দেশের অধিকার এবং যেকোনো অস্ত্রের চেয়ে আমার এই বিশ্বাসকেই বেশি শক্তিশালী মনে করি। আমরা আজ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমরাই জয়ী হবো।’
বিশিষ্ট লেখক রোগার গ্যারাউডির প্রধান রচনা
১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয়। সেখানে দুনিয়ার মুসলিম শাসককুলের প্রতি সাবধান বাণীটি ছিল “ইসরাইলের অগণিত লক্ষ্যসমূহের মধ্যে সবচাইতে ভয়ংকর হচ্ছে ফিলিস্তিনের অধিবাসীদিগকে হত্যা, জোর-জুলুম করে তাড়িয়ে দিয়ে তথায় ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এ কাজে তারা সফল হলে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে মুসলমান উচ্ছেদ তারা শুরু করবে। সেই অভিযান হবে হিটলারের নতুনরূপ।” (সুত্র : Garaudy, The Case of Israel)
সুতরাং সারা বিশ্বের শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে এ অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
আসুন, আমাদের প্রথম কেবলা মসজিদে আকসা পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে শামিল হয়ে ঈমানী দায়িত্ব পালন করি। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন।।