বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। আবহমান কাল ধরে বাংলাদেশে সকল ধর্মের মানুষ এখানে সহাবস্থান করে আসছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ শতকরা নব্বই ভাগের বেশি মুসলিম হলেও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের অনুসারীরা অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করে আসছেন যুগ-যুগ ধরে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বসবাস করছে। বিশেষ করে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীর অনেক দেশেই মুসলমানরা ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে নির্যাতিত হয়ে আসছে। ইউরোপ, আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, মিয়ানমার, চীনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই মুসলমানদের ওপর হত্যা, খুন, দেশান্তরিতসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে অহরহ। বর্তমানে মিয়ানমারে মুসলমানদের ওপর অমানবিক নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। মুসলমানদের রক্তে তাদের হাত রঞ্জিত হচ্ছে। তবুও এদেশে তাদের আশ্রয় দেয়া এবং সংখ্যালঘুরা শান্তিতেই বসবাস করছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন রাজনৈতিক না ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে হয় তা জানতে অনেক বড় গবেষণার প্রয়োজন নেই। এদেশে সংখ্যালঘুরা মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবের সময় নির্যাতিত হওয়ার একটি নজির নেই। যেটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে চলছে। গরুর গোশত খাওয়া ও রাখার দায়ে অনেক মুসলমানকে পিটিয়ে হত্যা করার পৈশাচিক ঘটনা অহরহ। অথচ বাংলাদেশে ঈদ-পূজায় আনন্দ ভাগা-ভাগির ইতিহাস অনেক পুরনো। কিন্তু দেশে যখনই রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে তখনই এক শ্রেণীর স্বার্থন্বেসী মহল রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘৃণ্য পথ বেছে নেয়।
সম্প্রতি কুমিল্লা নগরীতে হিন্দুদের পূজামণ্ডপে পবিত্র কুরআন অবমাননার ঘটনায় নগরীর নানুয়ার দীঘিরপাড়ের একটি দূর্গাপূজার মণ্ডপ ঘিরে এ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এলাকার মানুষ দীঘির পাড়ে একটি পূজামণ্ডপে হনুমানের মূর্তির পায়ের ওপর পবিত্র কুরআন দেখতে পান। বিষয়টি মুহুর্তের মধ্যে লোকজনের মুখে-মুখে জানাজানি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছবি ও ভিডিও ভাইরাল হয়ে পড়লে স্থানীয়রা সেখানে জড়ো হতে থাকেন। একপর্যায়ে তারা এ ঘটনার প্রতিবাদ এবং জড়িতদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে স্লোগান শুরু করে। এক পর্যায়ে পুলিশ ও ক্ষুব্ধ জনতার মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে নিহত-আহত, সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর ও মন্দিরে ভাংচুরের ঘটনা সংঘঠিত হয়েছে। এ ঘটনা এখন “ট্যক অব দ্যা কান্ট্রি”। ঘটনাকে নিয়ে প্রতিদিনই অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগের রাজনীতি চলছে। যেহেতু সামনে জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসেছে। সুতরাং দেশে-বিদেশে, সোস্যাল মিডিয়ায় ও এনিয়ে শোরগোল আলোচনা হচ্ছে। প্রতিদিনই সরকারী-দল, বিরোধী দল অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ অব্যাহত।
বিরোধী দল বলছে যেহেতু সামনে এই মেরুদন্ডহীন নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ। নতুন কমিশন কিভাবে হবে তা নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছে তখন জনগনের দৃষ্টি ভিন্নদিকে নিতে সরকারই এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে। তাছাড়া এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করছে। বিরোধীদল যেহেতু আন্দোলন করবে বলে ঘোষনা দিচ্ছে সুতরাং মামলা দিয়ে বিরোধীদের দমনের একটি সুযোগও তৈরী করছে সরকার। তাছাড়া ঘটনার কোন তদন্ত ছাড়াই এর জন্য বিরোধী মতকে দায়ী করছে সরকার। দেশের নাগরিক হিসেবে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দায়িত্ব সরকারের নয় কি? এদায় সরকার এড়াতে পারেনা। হযরত উমারের (রা.) শাসনামলে এক সংখ্যালঘু ব্যক্তি তার মূর্তি ভাঙ্গার জন্য বিচার প্রার্থী হলেন। তিনি গোয়েন্দাদের নির্দেশ দিলেন দোষীকে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করার। কিন্তু অপরাধীকে খুঁজে না পাওয়ার কারণে উমার (রা.) নিজেই সংখ্যালঘুকে তরবারী হাতে দিয়ে বললেন, ভাই আমি অপরাধীকে খুঁজে পেলাম না তাই তুমি আমাকে এই তলোয়ার দিয়ে শাস্তি দাও। তবুও কেয়ামতের দিন আমাকে আসামী করোনা। কারণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কেয়ামতের দিন সংখ্যালঘুর পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করবেন। উমার (রা:)-এর এমন আল্লাহ ভীতি আর দায়িত্বানুভূতি দেখে সংখ্যালঘু ইসলামের পতাকাতলে শামিল হয়েছে। সুতরাং সংখ্যালঘুর নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। এটি কারো প্রতি করুণা নয় বরং অধিকার।
কিন্তু সব কিছুর মাঝেও তাহলে আসল বেনিফিসিয়ারী কে? আমরা যদি পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি নিউজের চুম্বক অংশ সামনে রাখি তাহলে সম্মানিত পাঠকবৃন্দ অনেক কিছুই বুঝতে সক্ষম হবেন। দৈনিক প্রথম আলো লিখেছে- “পূজামণ্ডপে কোরআন পাওয়ার পর মিছিলের জন্য সংগঠিত করা যুবক, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ওয়ার্ড কমিশনারের ছেলে”। “চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনা নিয়ে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ শুরু করেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষ”। পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন অবমাননার ঘটনার ৭ দিন পর পুলিশ জানায়, যে ব্যক্তিটি কাজটি করেছেন তাকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। নাম ইকবাল হোসেন তিনি কুমিল্লা শহরের বাসিন্দা তবে ভবঘুরে ও মাদকাসক্ত”। পুলিশ বলছে জিজ্ঞাসাবাদে ইকবাল হোসেন একেক সময় একেক তথ্য দিচ্ছেন”। (২৩ অক্টোবর, দৈনিক প্রথম আলো)
বাংলাদেশের সব সরকারই কম বা বেশি, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে পশ্রয় দিয়েছে ও দিচ্ছে। তা তারা দিয়েছে ও দিচ্ছে ‘ভোটের জন্যে’, ‘ক্ষমতায় থাকার জন্যে’। অর্থাৎ শাসকশ্রেণী ও গোষ্ঠী না চাইলে সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি হবে না বরং তার বিলোপ ঘটবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই বাঙালি-অবাঙালির বিভেদ তৈরি করে জাতিকে বিভক্ত ও বিভ্রান্ত করে চলছে। উদ্দেশ্য লুটপাট, হিন্দুদের জমি দখল। হিন্দুদের তাড়াতে পারলে অর্থসম্পদ সম্পত্তির দখল আর দেশে থাকলে জোর জবরদস্তি করে ভোট নেয়াই তাদের মুদ্রা দোষে পরিণত হয়েছে। এদেশে সাম্প্রদায়িক বিভেদের পেছনে কোনো ধর্মীয় বিশ্বাস কাজ করেনি। সবই মূলত ঘটেছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ থেকে। (লুট, সম্পত্তি প্রাপ্তি, সহজে ক্ষমতাশালী হওয়া ইত্যাদি)
৫ জানুয়ারি একদলীয় নির্বাচনে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণে আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের পরিবারের ওপর হামলা চালিয়ে দেশের জনগণ ও আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এই চক্রান্ত চালায়। ফেনীর মালো পাড়ায় সহিংস ঘটনার জন্যে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার পর আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থী রণজিত কুমার রায় বলেছেন, “সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালিয়েছে তার প্রতিদ্বন্ধী আওয়ামী লীগ নেতা ও হুইপ শেখ আবদুল ওহাবের ক্যাডারেরা।” নির্বাচনের আগেই প্রকাশ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের তাকে ভোট না দেয়ার পরিণতি ‘ভয়াবহ হবে’ বলে শাসিয়ে দিয়েছিলেন” নির্বাচনের পর ওই দিন রাতে দিনাজপুর সদর উপজেলার কর্নাই গ্রামে হিন্দুদের কয়েকটি বাড়ি ও দোকানে ভাঙচুর হয়।
টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার হিন্দু অধ্যুষিত ফলদা ইউনিয়নে মন্দির পোড়ানোর ঘটনার প্রধান আসামি আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতাকে গ্রেফতার না করায় এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে নির্বাচন বর্জন করেছে সহস্রাধিক হিন্দু ভোটার। নোয়াখালীর কৃষ্ণপুরে হিন্দুদের ধর্মীয় উপাসনালয়ে হামলার ঘটনায় স্থানীয় পূজা কমিটি আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। পটুয়াখালীর শহরতলী লাউকাঠি বাজারে ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি বাহাদুর শেখের দাবিকৃত এক প্যাকেট সিগারেট ও ৫০০ টাকা না দেয়ায় তিনজন হিন্দু ব্যবসায়ীকে মারধর, দোকান-পাটে হামলা ও ভাংচুর করে প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে সে ও তার ক্যাডার বাহিনী। (সূত্র : আমার দেশ)
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। কক্সবাজারের রামু ও উখিয়ার বিভিন্ন বৌদ্ধ মন্দিরে ন্যাক্কারজনক এই হামলার ঘটনা ঘটে। ২৯ সেপ্টেম্বর রাত দশটায় প্রথম মিছিলটি বের হয় রামু উপজেলা আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি আনছারুল হক ভুট্টোর নেতৃত্বে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে- মিছিলটির শুরুতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম হোসেন। এ ছাড়াও হামলায় আরো নেতৃত্ব দেয় উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
সংখ্যালঘু হামলার ৮৩ ভাগে আ’লীগ জড়িত : প্রবীর মিত্র। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সারাদেশে যেসব সহিংসতা ঘটেছে সেগুলোর শতকরা প্রায় ৮৩ ভাগেই আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা ছিল বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ মাইনরিটি পার্টি। জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে পার্টির সাংগঠনিক সম্পাদক প্রবীর মিত্র এ অভিযোগ করেন। (সূত্র : ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ জাস্ট নিউজ)
বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের একজন নেতা সুব্রত চৌধুরী বলেন, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটলে সেটা এখন রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের ওপর দোষ চাপানোর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের লোকজনও জড়িত হয়েছে সেটা আমরা দেখতে পেয়েছি।’ (উৎস : ১০ জানুয়ারি, ২০১৪ বিবিসি বাংলা)
১৭৫৭ সালে বাংলা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির করতলগত হয়। শাসন ও শোষণের জন্যে তারা পলিসি গ্রহণ করে তা হচ্ছে ‘ভাগ করো ও শাসন করো’। লর্ড এলফিনস্টোন ১৮৫৮ সালে তিনি ‘ভারতের রাষ্ট্রসচিব চার্লস উড ১৮৬২-তে ভাইসরয়কে লিখেছিলেন যে, ভারতের ‘জাতিগুলির’ অন্তর্দ্বন্ধই ভারতে ব্রিটিশদের শক্তি যোগাবে। তাই ‘এই বিভেদকারী শক্তিকে’ জিইয়ে রাখতে হবে, কারণ সমগ্র ভারত আমাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হলে আর কতদিন আমরা টিকে থাকতে পারব?
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ১৯৪৭ সালে ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা হাতে পাওয়ার পর বলেই ফেললেন, ‘মুসলিমদের এক হাজার বছরের প্রতিশোধ নিলাম।’ আর প্রতিশোধ নেয়ার ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে ১৯৪৮ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর রাতের অন্ধকারে মুসলিম ঐতিহ্যের লীলা ভূমিখ্যাত স্বাধীন-সার্বভৌম হায়দারাবাদ আক্রমণের মাধ্যমে লাখ লাখ মুসলিম হত্যা, হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রমহানি, শত-শত ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভারত তার প্রথম রক্তপান উদ্বোধন করে। শত-শত হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার আড়ালে মুসলিম নিধন করতেও ভারত একটুও পিছপা হয়নি।
কিন্তু ইসলাম সুযোগ পেলেই আক্রমণের নির্দেশ দেয়নি। অমুসলিম নাগরিকের রক্তের মূল্য মুসলমানদের রক্তের মূল্যেরই সমান। রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমলে জনৈক মুসলমান অমুসলিমকে হত্যা করলে তিনি খুনিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। তিনি বলেন, “যে নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়া হয়েছে, তার রক্তের বদলা নেয়ার দায়িত্ব আমারই।” (ইনায়া শরহে হিদায়া, ৮ম খণ্ড) হযরত ওমর রাদিয়ালাহু তা’য়ালা আনহুর আমলে বকর বিন ওয়ায়েল গোত্রের এক ব্যক্তি জনৈক হীরাবাসী অমুসলিম জিম্মিকে হত্যা করে। তিনি খুনিকে নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের হাতে সমর্পণের আদেশ দেন। অতঃপর তাকে উত্তরাধিকারীদের হাতে সমর্পণ করা হলে তারা তাকে হত্যা করে। (বুরহান শরহে মাওয়াহিবুর রহমান, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮৭)
“যে অমুসলিম নাগরিককে কষ্ট দিল আমি তার বিরুদ্ধে কিয়ামতের দিন বাদি হবো। আর আমি যার বিরুদ্ধে বাদি হবো আমি কিয়ামতের দিন জয়ী হবো।” (তারিখে বাগদাদ) ‘যে সংখ্যালঘুকে কষ্ট দিল সে আমাকে কষ্ট দিল আর যে আমাকে কষ্ট দিল সে স্বয়ং আল্লাহকে কষ্ট দিল।’ (তাবরানি আওসাত) এ ছাড়াও ফৌজদারি দণ্ডবিধি, সম্মানের হিফাজত, পারিবারিক বিষয়াদি, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, উপসনালয়, জিযিয়া ও কর আদায়ে সুবিধা দান, অমুসলিমের চিরস্থায়ী নিরাপত্তা, বাকস্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা, শিক্ষা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও পেশা, চাকরি, অমুসলিমদের নিরাপত্তার একমাত্র উপায়, সামরিক চাকরি থেকে অব্যাহতি ইত্যাদি অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের একান্ত দায়িত্ব।
ইসলাম অধিক ইনসাফ, সহিষ্ণুতা, উদারতা ও বদান্যতার ইতিহাস কায়েম করেছে। বাংলাদেশে হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ, জৈন বহু ধর্মাবলম্বী মানুষ আছেন, তারা স্বাধীনভাবে রুজি-রোজগার করেন, পূজা-পার্বণ করেন এবং স্বাধীনভাবে তাদের সকল অধিকার নির্বিঘ্নে ভোগ করে আসছেন।
ইসলাম সকল প্রকার সাম্প্রদায়িক শ্রেণিভেদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আসছে। লঘিষ্ঠ আর গরিষ্ঠকে মুক্ত করতেই এই জীবনব্যবস্থার আগমন। ইসলামের লক্ষ্যই হচ্ছে সকল প্রকার ভেদাভেদ উঁচু-নিচু, হিংসা-বিদ্বেষমুক্ত সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা। যারা মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহির মানসিকতাকে লালন করে তারা কখনোই অন্যের অধিকার হরণ, সামাজিক অনাচার সৃষ্টি ও সম্পদ লুণ্ঠনের মতো গর্হিত কাজ করতে পারে?
আমরা বিশ্বাস করি, ইসলামের সৌন্দর্য খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে গোটা পৃথিবীর মানুষকে যেভাবে আকৃষ্ট করেছে, সুতরাং কোন মুসলমান সংখ্যালঘু নির্যাতনে অংশ নিতে পারেনা। ইসলাম ধর্ম আগমনের পূর্বে এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল না বললেই চলে; কিন্তু মুসলমানদের আগমনের মধ্য দিয়েই এখানে ইসলামের সৌন্দর্য সহনশীলতা পারস্পরিক বন্ধনকে সুদৃঢ় ও মজবুত করেছে। এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায় ইসলাম ধর্মের পতাকাতলে সমবেত হয়। বাংলার এই জনপদে তরবারি তথা বল প্রয়োগের মাধ্যমে নয়, বরং ইসলাম প্রচারকগণের সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবন-যাপন এবং ব্যাপক দানশীলতা, উদার ও সহমর্মী মনোভাবই এতদঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাধিক্যের অন্যতম তথা একমাত্র কারণ। মুসলমানরা সিন্ধু জয় করে ৭১১ সালে। ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত বাংলায় মুসলিম শাসকদের শাসন চালু ছিল। ঐতিহাসিক ইলিয়ট লিখেছেন, বিন কাসিম ‘সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, মুখ্য অধিবাসী ও ব্রাহ্মণদের মন্দির নির্মাণ, মুসলিমদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, নির্ভয়ে বসবাস ও আত্মোন্নতির জন্য প্রতিযোগিতা করার নির্দেশ দিলেন।
আজও যদি আমরা সে দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারি, তাহলে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে ইসলামের আলোয় উদ্ভাসিত হবে সারা পৃথিবী। একশ্রেণি স্বার্থান্বেষী মহল সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, নির্যাতন, তাদের সম্পদ লুটপাট করে লাভবান হচ্ছে। আবার আর এক শ্রেণি শুধুমাত্র রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্যে মিডিয়ার মাধ্যমে এর কল্পকাহিনী তৈরি করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও ইসলামকে বিপন্ন করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। আজ আমাদেরকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সুদৃঢ় করতে হবে এ দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য সম্প্রীতির বন্ধনকে।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা।