বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার কয়েকটি লাইন দিয়ে শুরু করছি- ‘‘অশান্তি-কামী ছলনার রূপে জয় পায় মাঝ মাঝে, অবশেষে চির-লাঞ্ছিত হয় অপমানে আর লাজে! পথের ঊর্ধ্বে ওঠে ঝোড়ো বায়ে পথের আবর্জনা তাই বলে তারা ঊর্ধ্বে উঠেছে-কেহ কভু ভাবিও না! ঊর্ধ্বে যাদের গতি, তাহাদেরি পথে হয় ওরা বাধা; পিচ্ছিল করে পথ, তাই বলে জয়ী হয় না ক কাদা!’’ এই কবিতার লাইনগুলো দেখে মনে হবে কাজী নজরুল ইসলামের এই কবিতা রচনা করেছেন গত ১৩ নভেম্বর বেগম খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে অমানবিক কায়দায় উচ্ছেদের পর। কিন্তু তা নয়। আমাদের ভবিষ্যতের কবি নজরুল হয়ত উপলব্ধি করেছেন যুগে যুগে থাকবে সংকীর্ণতা আর অমানবিকতার ইতিহাস।
আমি বিশ্বাস করি, কবি আজ জীবিত থাকলে বেগম খালেদা জিয়াকে যে অমানবিক, নিলর্জ্জ, কদার্য ও স্বৈরাচারী কায়দায় বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দীর্ঘ ৩৮ বছরের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি থেকে ঈদের ঠিক পূর্বক্ষণে যেভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে এর প্রতিবাদে এর থেকে অনেক কঠিন ভাষায় কবিতা রচনা করতেন । খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্ট-এর বাড়িটি সাধারণ কোন বাড়ির মত নয়। এটি হচ্ছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বর্তমান বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার স্বামী হারানোর দুঃখ ও বেদনার স্মৃতি সম্বলিত একটি ঠিকানা। এটিকে মূল্যের তালিকায় ওজন করা, এক ধরনের সংকীর্ণতা ও বোকামী ছাড়া আর কিছুই নয়। এটি যেমন খালেদা জিয়ার কাছে অমূল্য রত্ন তেমনি বর্তমান আওয়ামী সরকার, এ বাড়ি থেকে খালেদা জিয়ার উচ্ছেদের টার্গেট ছিল, জিঘাংসার সর্বনিম্ন স্তর।
এটিকে আওয়ামী লীগ বাড়ির তালিকায় না রেখে প্রতিশোধ গ্রহণের চরম তালিকার অন্তর্ভুক্ত করেছে। মূলত শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত আক্রোশের শেষ পেরেক ঠুকলেন খালেদা জিয়ার প্রতি। আর বিএনপিও এটিকে শুধু মাত্র বাড়ি হারানোর বেদনায় না রেখে গোটা জাতীয়তাবাদী শক্তির অস্তিত্বের সিম্বলিক বা প্রতীক হিসাবে গ্রহণ করছে। আমাদের প্রত্যেকেরই বাপ-দাদার স্মৃতিবিজড়িত জীর্ণকুটিরকে আমরা যেমনি শ্রদ্ধার সাথে হৃদয়ের মণি কোঠায় স্থান দেই, সম্ভবত খালেদা জিয়ার কাছেই এই বাড়িটিও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বেদনাবিধুর কান্না বিজড়িত মুহূর্তেও আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতার, ব্যঙ্গাত্মক কটুক্তি ও আক্রমণাত্মক বক্তব্য থেকেও রেহাই পাননি বেগম খালেদা জিয়া। আমাদের সমাজে যত আজন্ম শত্রুই হোক না কেন, দুঃখ-বেদনার সময়ে সহানুভূতি দেখাতে না পারলেও অন্তত আক্রমণ না করাটা ন্যূনতম সৌজন্যতা হিসাবে বিবেচিত। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেই সীমাটিও রক্ষা করতে পারে নাই। একটি বাড়ি হারানোর বেদনায় খালেদা জিয়া যেমনি অশ্রুসিক্ত আর গোটা জাতি এ ঘটনায় হয়েছে মর্মাহত। আর জনগণ উদ্বিগ্ন এই জন্য দেশ আবার হিংসা, ক্রোধ ও অনিশ্চয়তার হিমাঙ্কের দিকে ধাবিত হচ্ছে । তাছাড়া শেখ হাসিনা এর আগের বার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ক্ষমতার অস্ত্র ব্যবহার করে গণভবন নিজের নামে এক টাকা মূল্য গ্রহণ করা, আর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান শাহাদাত বরণ করার পর, তার শোকাহত বিধবা স্ত্রী ও এতিম সন্তানদের ক্যান্টেনমেন্টের বাড়ি দেয়া এক কথা নয়। আজকে কেউ কেউ সেই ইতিহাস ভুলে গিয়ে দু’টিকে একই পাল্লায় মূল্যায়ন করছে। এটিও আমাদের সমাজে আরেক প্রকার তথ্য সন্ত্রাস। প্রত্যেকটা বিষয়কে আমরা ওই সময়ের সাথে মিলিয়ে দেখতে পারি না। আর না পারলে কোন ঘটনারই প্রকৃত মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়।
এবার পাঠকবৃন্দ আসুন আন্তর্জাতিক মহলে আওয়ামীলীগের এই জঘন্য কাজটিকে কিভাবে দেখছে তার সামান্য বিবরণ- ‘‘ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত ইকোনমিস্ট পত্রিকার গত ১৮ নভেম্বর সংখ্যায় এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এতে বলা হয়, ঈদের ঠিক আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে তার সেনানিবাসের বাসভবন থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার ওপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে বাংলাদেশে ঘৃণার রাজনীতি ফিরে এসেছে। এতে আরো বলা হয়, বেগম জিয়ার ওপর শেখ হাসিনার প্রতিহিংসাপরায়ণতায় ভারত সরকারেরও সমর্থন রয়েছে। ভারতও চায় জিয়া পরিবারের ধ্বংস। সেনাসমর্থিত দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও কারামুক্তির দুই বছরের বেশি সময় পর বাংলাদেশের প্রতিদ্বনদ্বী দুই রাজনৈতিক পরিবারের নেতারা ফের ঘৃণা ও দ্বনেদ্ব লিপ্ত হয়েছেন। তবে এবার এটা প্রধানমন্ত্রী হচ্ছে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে। বেগম জিয়া প্রায় ৩০ বছর ধরে ঢাকা সেনানিবাসের যে বাড়িতে বসবার করে আসছিলেন, গত ১৩ নভেম্বর সেখান থেকে তাঁকে উচ্ছেদ করা হয়। এর প্রতিবাদে বেগম জিয়ার দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) হরতাল ডাকে। তার সমর্থন ও শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের মধ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। শেখ হাসিনা চতুরতার সাথে বেগম জিয়ার বাসভবনের চারপাশের বিশাল এলাকাকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরের এক বিদ্রোহে নিহত ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তার পরিবারের বাড়ি নির্মাণের জন্য বরাদ্দ করেন। এই উচ্ছেদ ছিল বিএনপি’র মেরুদন্ড ভেঙে দেয়ার আওয়ামী লীগের মিশনের অংশবিশেষ। বেগম খালেদা জিয়ার মরহুম স্বামী ১৯৭১ সালে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিন্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক পরিবারের চিহ্ন মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর আওয়ামী লীগ।
বেগম জিয়ার একমাত্র আশা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুৎ ঘাটতি ও পুঁজিবাদী দুর্বৃত্তায়নে শেখ হাসিনার সরকারের খোলামেলা সমর্থনে জনগণ হতাশ হয়ে পড়ছে। সরকারের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ইতোমধ্যে কমতে শুরু করেছে। অবশ্য শেখ হাসিনার প্রতিহিংসাপরায়ণতা ভারত সরকারের সমর্থন পেয়েছে, তাদের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক বেশ উন্নত হয়েছে। বেগম জিয়ার রাজনৈতিক পরিবারটিকে ধ্বংস করা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার প্রায় মতাদর্শে পরিণত হয়েছে, দেশটি মনে করে তার পরিবার ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়ার মধ্যে শেখ হাসিনার সমর্থন কমছে, খালেদা জিয়ার বাড়ছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ব্যক্তিগত ক্ষোভভিত্তিক বিভক্তির রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের লেগে থাকাটা আশ্চর্যের বিষয়।’’ বিজ্ঞ পাঠকবৃন্দ আওয়ামীলীগ বরাবরই মনে করে আসছে বিএনপি সবসময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আনুকূল্য পেয়ে আসছে।
সুতরাং বিএনপি এবং সেনাবহিনীর দূরত্ব সৃষ্টির জন্য আওয়ামী লীগ এটিকে মোক্ষম সময় হিসাবে গ্রহণ করে আর উভয়ের ব্যবধানের দেয়াল তুলতে ব্যবহার করে আইএসপিআরকে। সচেতন পাঠকবৃন্দ এবার দেখুন, আইএসপিআরের নানা রকম ভাষ্য- খালেদা জিয়ার বাড়ির দখল নেয়া প্রসঙ্গে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) কয়েক দফায় নানা রকম বক্তব্য দিয়েছে। প্রথমে আইএসপিআর থেকে বলা হয়, খালেদা জিয়া আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বেচ্ছায় বাড়ি ছাড়ছেন। বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেলে আইএসপিআর-এর এই বক্তব্য প্রচার করা হয়। উচ্ছেদ প্রক্রিয়া চলাকালে সকাল ১০টা ১০ মিনিটে প্রেস ব্রিফিং করে আইএসপিআর পরিচালক শাহীনুল ইসলাম বলেন, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ক্যান্টনমেন্ট বেবার্ডের জমি ক্যান্টনমেন্ট দখল নিচ্ছে। বেলা সোয়া ৩টার দিকে তিনি আরেক দফা ব্রিফিং করে খালেদা জিয়াকে তার বাড়ি ছেড়ে বাইরে যাওয়ার বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে সাংবাদিকদের জানান।
অন্যদিকে সন্ধ্যায় গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আইএসপিআর জানায়, ‘বিকাল ৩টা ১৫ মিনিটে বিরোধী দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের আদেশের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা দেখিয়ে স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আদালতের রায় বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেছেন। তিনি তাঁর সাথে নিত্যব্যবহার্য অধিকাংশ দ্রব্য নিয়ে গেছেন। বাকি জিনিসপত্র কর্তৃপক্ষ তাঁর ইচ্ছানুযায়ী যথাসময়ে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করবে।’ সকালের প্রেস ব্রিফিংয়ে আইএসপিআর পরিচালক শাহীনুল ইসলাম বলেন, মইনুল রোডের বাড়ি সংক্রান্ত মামলায় মহামান্য হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, যে যুক্তিতে মইনুল রোডের বাড়িটি বেগম খালেদা জিয়াকে বরাদ্দ দেয়া হয়, শুরুতেই তার প্রক্রিয়া ছিল ত্রুটিপূর্ণ। তারপরও মানবিক দিক বিবেচনা করে মহামান্য হাইকোর্ট খালেদা জিয়াকে বাড়ি ছাড়ার জন্য এক মাসের সময় দিয়েছেন। সে অনুযায়ী ১২ নভেম্বর সময় শেষ হয়ে গেছে। সেহেতু শনিবার থেকে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড ক্যান্টনমেন্টের জমি পুনরুদ্ধার করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
সচেতন পাঠকবৃন্দ খালেদা জিয়া বের না হওয়া পর্যন্ত আইএসপিআর পরিচালক এক রকম বক্তব্য রেখেছেন আর খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করার পর আইএসপিআর তাদের বক্তব্য শুধু পরিবর্তনই করেনি রীতিমত রাজনৈতিক প্রতিহিংসার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন। খালেদা জিয়া স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছেন মর্মে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত সংবাদ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা বলিনি খালেদা জিয়া স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছেন। আমরা বলেছি, আমরা আশা করছি তিনি বাড়িটি স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেবেন। সাংবাদিক ও আইনজীবীদের ঢুকতে না দেয়া সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে আইএসপিআর পরিচালক বলেন, ক্যান্টনমেন্ট সংরক্ষিত এলাকা। সেখানে তারাই প্রবেশ করতে পারবেন যাদের প্রবেশের অনুমতি আছে। বাড়ির আসবাবপত্র ভাংচুর সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে আইএসপিআর পরিচালক বলেন, ওখানে যারা আছেন, তারা অত্যন্ত দায়িত্বশীল ব্যক্তি; সুতরাং সেখানে এ ধরনের ভাংচুরের ঘটনা ঘটার কোনা প্রশ্নই আসে না। (দৈনিক আমার দেশ ১৪ নভেম্বর) আমার মনে হয়, ঐদিন খালেদা জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদের ঘটনায় জাতি যতটুকু মর্মাহত হয়েছেন তার থেকে কষ্ট পেয়েছেন আইএসপিআর-এর নানামুখী ও রাজনৈতিক কৌশলপূর্ণ এ বক্তব্য শুনে।
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ বিরোধী দলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তার উপর এই অন্যায় অত্যাচারের বিচারের ভার দিয়েছেন আল্লাহ ও দেশবাসীর কাছে। তাই আসুন যাকে নিয়ে এসব আয়োজন তার মুখেই আমরা শুনি সে দিনের ঘটনা। বিরোধী দলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে তাকে জোর করে এক কাপড়ে দীর্ঘদিনের স্মৃতিবিজড়িত ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বাড়ি ও বাসার মূল গেট ভেঙে ওরা (আইন-শৃক্মখলা বাহিনীর সদস্য) ভেতরে ঢোকে। গ্রিলের নেট কেটে ও বেডরুমের দরজা ভেঙে আমাকে টেনেহিঁচড়ে বের করা হয় এবং ধাক্কা দিয়ে গাড়িতে তোলা হয়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ওরা অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেছে। বলেছে, ‘উনি যদি না আসতে চায়- কোলে করে তুলে নিয়ে আসো’। ‘আমাকে আজ সারাদিন যে অবস্থায় রাখা হয়েছে তা বলতে পারছি না। সারাটা দিন আমি কিছু খেতে পর্যন্ত পারিনি। বলপূর্বক যেভাবে আমাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হলো কার কাছে আমি বিচার চাইব এই বিচারের ভার আল্লাহ ও দেশবাসীর কাছেই দিলাম।’ নিজের গুলশানের কার্যালয়ে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে কান্নাজড়িত কন্ঠে বিরোধীদলীয় নেতা আরও বলেন, ‘আমাকে যেভাবে বাড়ি থেকে বের করা হয়েছে তাতে আমি শুধু অপমানিত ও লাঞ্ছিতই নই, লজ্জিতও হয়েছি।’
বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, সাবেক সেনাপ্রধানের স্ত্রী ও স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ জিয়ার সহধর্মিণী এবং দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসন হওয়া সত্ত্বেও আমাকে যেভাবে অসম্মান করা হয়েছে তাতে সহজেই অনুমান করা যায়, দেশের সাধারণ মানুষ আজ কত অসহায়, কত কষ্টে আছে। ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মইনুল রোডের ৬নং বাড়িটির সঙ্গে তার স্বামী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্মৃতিময় সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে আবেগ আপ্লুত খালেদা জিয়া বলেন, ৪০ বছরের স্মৃতিময় বাড়ি থেকে আমাকে জোর করে বের করে দিয়ে ওই বাড়ির সঙ্গে ছিন্ন করা হলো আমার সম্পর্ক। দীর্ঘদিনের সংসারের সব মালামাল রেখে আমাকে এক কাপড়ে বের করে দেয়া হয়েছে। এই বাড়িটি নিয়ে সরকার অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকার পরও মামলা নিত্তির আগেই এ বাড়ি থেকে আমাকে বের করে দিয়ে উচ্চ আদালতের সম্মানকে সরকার পদদলিত করেছে। সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়ার ৯ মিনিটের সংক্ষিপ্ত মর্মস্পর্শী বক্তব্যের সময় শুধু তার চোখ বেয়েই অশ্রু আসেনি উপস্থিত নেতাকর্মী এবং সাংবাদিকদের চোখেও পানি এসে যায়। চোখের পানি মুছতে মুছতে খালেদা জিয়া বলেন, ওই বাড়ির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে আমার দুঃখ, বেদনা, সুখ ও আনন্দের নানা স্মৃতি। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জীবন দেয়ার পর ওই বাড়িকে ঘিরে আমার আবেগ আরও বেড়ে যায়। আজ জোর করে সেই আবেগ ও স্মৃতিময় বাড়ি থেকে আমাকে বের করে দেয়া হলো। খালেদা জিয়া বলেন, এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর শহীদ মইনুল রোডে আমার বাড়ি নিয়ে কেবিনেটে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করে। বেআইনি নোটিশ দিয়ে আমাকে বাড়ি ছাড়তে বললে আমি আদালতের শরণাপন্ন হই। উচ্চ আদালতে রায় হলেও আইন অনুযায়ী আমি আপিল করেছি।
আগামী ২৯ নভেম্বর আপিলের শুনানি হওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হলো। আইএসপিআর কর্মকর্তার বক্তব্য প্রসঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা বলেছে আমি নাকি বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছি। তারা মিথ্যা কথা বলছে। এটা বানোয়াট, মিথ্যাচার। জোর করে ধাক্কা মেরে ওরা আমাকে গাড়িতে তুলেছে। এর আগে গ্রিল কেটে ওরা স্টাডি রুমে ঢুকেছে। বেডরুমের দরজা ভেঙেছে। জিনিসপত্র তছনছ করেছে। এমনভাবে এলোমেলো করেছে… বলে মুখ চেপে ধরে খালেদা জিয়া প্রায় ৩০ সেকেন্ড কান্না করতে থাকেন। কাজের লোকদের আগেই ধরে নিয়ে যায়। তাদের পরিবার-পরিজনকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। আইএসপিআর’র পক্ষ থেকে জানানো হয়, খালেদা জিয়া বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে পুরো বাড়িটি সিলগালা করা হয়েছে। অথচ পরেরদিন কয়েক বোতল মদ আর কয়েকটি পর্ণো ম্যাগাজিন খালেদা জিয়ার শোয়ার ঘরে রেখে নাটক সাজিয়ে সাংবাদিকদের দাওয়াত করে যেভাবে দেখানো হয়েছে তা গোটা জাতিকে হতবাক করেছে যে, জাতি হিসাবে আমরা প্রতিহিংসার কোন পর্যায়ে অবস্থান করছি। এই নির্জল আঘাতটি সরকার না করলেও পারত। আমার মনে হয় এদেশের জনগণ এখনো বিশ্বাসের ব্যাপারে এত নিম্ন পর্যায়ে পৌছে নাই যে, বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, সাবেক সেনাপ্রধানের স্ত্রী ও স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ জিয়ার সহধর্মিণী এবং দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসন এর বক্তব্যকে একজন আইএসপিআর পরিচালকের বক্তব্যের তোড়ে সত্যটি বুঝতেই পারবে না। এমনটি হওয়ার কথা নয়। আমাদের দেশের ক্ষমতাসীনদের সবচেয়ে বড় সমস্য এদেশের সাধারণ মানুষ যে সব কিছু বোঝে, এটাই আমাদের রাজনীতিবিদরা বোঝেন না।
খালেদা জিয়ার কান্নাকে আজ নানাভাবে ব্যাখ্যা করছেন অনেকেই। কেউ বলেন, যিনি জনগণের নেত্রী তিনি সামান্য একটি বাড়ি হারিয়ে এভাবে কান্নায় ভেঙে পড়বেন ভাবা যায় না। কেউ বলছেন, জনতার সমর্থন আদায়ের এ এক রাজনৈতিক কৌশল। এগুলো খালেদা জিয়ার ‘‘কাটা ঘায়ে লবণের ছিটা’’ ছাড়া অন্যকিছু নয়। কারণ দেশের মানুষ দেখেছে- স্বামীর কফিনের সামনে দাঁড়িয়েও খালেদা জিয়া ছিলেন অবিচল। ওয়ান ইলেভেনের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন যখন তার জ্যেষ্ঠ পুত্রের মেরুদন্ডের হাড় ভেঙে পঙ্গু করে দিয়েছিল তখন তিনি কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেননি। কনিষ্ঠ পুত্র হুইল চেয়ারে বসে যখন বুক ধরে কাতরাচ্ছিলেন তখনো খালেদা জিয়ার চোখে কেউ একবিন্দু অশ্রু দেখেনি। তিনি ওয়ান ইলেভেন নির্মিত কারাগারে আপসহীন নেত্রীর মতই দৃপ্ত পায়ে হেঁটে গিয়ে প্রবেশ করেছিলেন। সেই নেত্রী যখন একটি সরকারি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেই সংবাদ সম্মেলনে বসে কান্নায় অাঁচলে মুখ ঢাকেন তখন তা নিয়ে রসিকতা ও ব্যঙ্গ করার সুযোগ কতটুকু সমীচীন তা আমাদের ভাববার বিষয়।
বিরোধী দলীয় নেত্রী যে বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছেন সেই বাড়িটিকি ছিল শুধুই কয়েকটি ঘরের সমষ্টি নয়! শুধুই আঙিনা জোড়া ফুলের বাগান অথবা ৮ বিঘা জমির বিশাল সীমানা অথবা রাত্রিবাসের ঠিকানা নয়। ওই বাড়ির প্রতিটি ইট-পাথরে ছড়িয়ে আছে ৩৮ বছরের হাজারো স্মৃতি। ওই বাড়িতেই মেজর জিয়াউর রহমান ধীরে ধীরে মেজর জেনারেল হয়েছেন। রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। ওইসব স্মৃতি অর্থমূল্য কেনা যায়? তাই যারা ওই বাড়িটির আর্থিক মূল্য নির্ণয় করছেন এটিও এক কদার্য রাজনীতি। তাই মনে হয়, একজন বিষন্ন মানুষের নিকট থেকে সম্পদ নয় কেড়ে নেয়া হয়েছে সারা জীবনের স্মৃতি। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া এই বিচারের ভার আল্লাহ ও দেশবাসীর কাছে দিয়েছেন। একথা সত্য, আল্লাহর দরবারে মজলুমের চোখের পানি বৃথা যায় না।