আহলান সাহলান মাহে রামাদান, খোশ আমদেদ ইয়া রামাদান বলে মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর রমজান কে স্বাগত জানায়। কিন্তু প্রতিবার রমজান আসলেই রক্ত পিপাসু হায়েনারা মুসলমানদের রক্ত দিয়ে হলি খেলা শুরু করে। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় নিজেদের ভূমি রক্ষার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী ফিলিস্তিনীদের ওপর ইসরাইলী বাহিনীর বর্বর হামলা ইতিহাসের সকল নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতাকে হার মানিয়েছে। এই সন্ত্রাসী বাহিনীর উপর্যুপরি হামলায় অর্ধশতাধিক ফিলিস্তিনী নিহত এবং দু’সহস্রাধিক আহত হয়েছেন। ইসলাইলী সেনাদের হিংস্র হামলায় গাজা উপত্যকা এখন যেন মৃত্যুপূরী।। মজলুম ফিলিস্তিনীদের রক্তে রঞ্জিত গাজাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদ। ইতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাকান্ডে মুসলিমবিশ্ব এখনো নিরব! মিয়ানমার,সিরিয়া,আফগান,কাশ্মীর সর্বত্র মুসলমানদের রক্ত ঝরছে। মজলুমদের কান্নার আওয়াজ আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছে কিন্তু অন্য মুসলিমদের হৃদয়ে তেমন নাড়া দিচ্ছে না। একদিকে মুসলমানদের রক্তের স্রোত অন্যদিকে অনেকেই রমজানে হরেক রকম ভুরী ভোজের প্রস্তুতি! একদিকে মুসলমানদের হত্যা করছে আরেকদিকে কাউকে দাওয়াত দিয়ে জমকালো ইফতার আর শুভেচ্ছা বিনিময় করছে মুসলমানদের রক্ত খেকো শাসকরা। এ যেন এক তামাশা! অথচ আল্লাহ বলেছেন-তোমাদের কি হলো, তোমরা আল্লাহর পথে অসহায় নর-নারী ও শিশুদের জন্য লড়ছো না , যারা দুর্বলতার কারণে নির্যাতিত হচ্ছে? তারা ফরিয়াদ করছে , হে আমাদের রব! এই জনপদ থেকে আমাদের বের করে নিয়ে যাও, যার অধিবাসীরা জালেম এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের কোন বন্ধু, অভিভাবক ও সাহায্যকারী তৈরি করে দাও। (সূরা-নিসা-৭৫)
মুসলমানদের নিকট রমজান আসে যায় কিন্ত তাদের ভাগ্য যেন পাল্টায়না! মুসলমানরা ক্ষুধা দারিদ্রতা থেকে মুক্তি পাচ্ছেনা। শুধু সওয়াবের বন্যা বয়ে দিতে রমজান আসেনি।বরং ইসলাম এসেছে মানবতাকে মুক্তি দিতে। শুধু শাসন-শোষন বঞ্চনা ,লাঞ্চনা অপমান হওয়া নয়। ইসলাম এসেছে মুসলমানদের শাসকের আসনে বসিয়ে সম্মান, মর্যাদা, ইনসাফ মানবিক গৌরবোজ্জল সমাজ বিনির্মাণ করতে। মহাগ্রন্থ আল-কোরআন আমাদের কাছে আছে, তাহলে আসল সংকট কোথায়? তা আবিস্কার করতে হবে আমাদেরকে।ইসলামী স্কলারদের খুঁজে বের করতে হবে আসল কারণ। মুসলমানরা আজ কুরআনের জ্ঞান ছাড়া দুনিয়ার যাবতীয় সব জ্ঞান রপ্ত করেছে। কুরআনের হুকুমেরআমল না করে, তথাকথিত পীর-বুজুর্গ, ভন্ডদের হুকুম তামিল করছে।তাবেদারী করছে এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো, এটাই আসল সমস্যা। যুগে যুগে বিশ্ব মজলুম মানবতার মুক্তির জন্য¨ এই রমজান মাসেই আল্লাহ তায়ালা সব আসমানি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন । এ মাসেই ইব্রাহিম (আ.) এর সহিফা গুলো প্রেরিত হয়েছে। হজরত দাউদ (আ.)-এর প্রতি যবুর শরীফ এই মাসের ১২ অথবা ১৮ তারিখে নাজিল হয়েছে। হজরত মুসা (আ.) এর তওরাত শরীফ রমজান মাসের ৬ তারিখে অবতীর্ণ হয়েছে। হজরত ঈসা (আ.)-এর প্রতি ইনজিল কিতাব এই মাসের ১২ কিংবা ১৩ তারিখে অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মানব জাতির হেদায়েতের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল কোরআন আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ (ﷺ)-এর ওপর এই রমজান মাসেই অবতীর্ণ করেছেন, আর মানুষকে দিয়েছেন খেলাফতের দায়িত্ব।
রোজা ফারসি শব্দ যার অর্থ উপবাস। আরবি রজম থেকে রোজা অর্থ পোড়ানো বা দহন করা। রোজার মাধ্যমে মানুষ তার পাপ প্রবণতাকে দহন করে নির্মূল হয়। আর সিয়াম বহুবচন, একবচনে সাওম অর্থাৎ স্থগিত রাখা, বিরত রাখা, চুপ থাকা, আত্মসংযম ইত্যাদি। সুতরাং সুবহে সাদিক অর্থাৎ প্রভাতের আলোর সাদা রেখা প্রকাশের সময় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত থাকাকে সিয়াম বলা হয়। তাই আল্লাহ তায়ালা বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজাকে ফরজ করা হয়েছে যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপরও ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা পরহেযগার হতে পার।” (সূরা-বাকারা : ১৮৩)
আল্লাহ তায়ালা মানুষের মর্যাদা নির্ণয় করেছেন তাকওয়ার ভিত্তিতে। আর তাকওয়া হলো আল্লাহর ভয়। আল্লাহ বলেন-”ইন্না আকরামাকুম ইন্দাল্লাহে আত্কাকুম” অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত যে সবচেয়ে বেশি তাকওয়ার অধিকারী। আল্লাহকে ভয় করার পূর্ণাঙ্গতা প্রকাশ পায় সিয়ামের মধ্য দিয়ে, যা অন্য কোনো ইবাদতের মধ্যে ততটুকু প্রকাশ পায়না। যেমন-নামাজ, মানুষকে দেখানোর ইচ্ছা থেকে পড়া যেতে পারে। আল্লাহ বলেন, “তাদের জন্য ধ্বংস যারা লোকদেখানো নামাজ আদায় করে।” হজ্বের মধ্যে অহঙ্কার থাকতে পারে। ঘটা করে জাকাত প্রদান করা আজকাল আমাদের সমাজে তো রসমে পরিণত হয়েছে। মাঝে মধ্যে যাকাত আনতে গিয়ে গরিব মানুষ পিষ্ট হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে । অথচ যাকাত গরিবের অধিকার, তার বাড়িতে গিয়ে তাকে যাকাত প্রদান করে আসার কথা, যেমনি পাওনাদারের পাওনা পরিশোধ করা হয়। সাওম বা রোজা এমন একটি ইবাদত যা মানুষ সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য আল্লাহকে ভয় করার সর্বোত্তম একটি প্রশিক্ষণ। রোজা কেবল মানুষ আল্লাহর ভয়ে রাখে। রোজা মানুষকে দেখানো যায় না। রমজানের একটি নফল অন্য সময়ের ফরজের সমতুল্য, রমজানের একটি ফরজ অন্য সময়ের সত্তরটি ফরজের সমান।
রোজাদারের মুখের গন্ধ মিশ্ক আম্বরের মতো। রাসুল (ﷺ) বলেন, মানুষের প্রত্যেকটি কাজের ফল আল্লাহর দরবারে কিছু না কিছু বৃদ্ধি পায়। একটি নেক কাজের ফল দশ গুণ থেকে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি হয়ে থাকে। আল্লাহ বলেন, রোজাকে এর মধ্যে গণ্য করা হবে না। কারণ রোজা খাস করে কেবল আমার জন্য রাখে। আর আমিই তার প্রতিদান দেব। রোজাদারের আনন্দ দুটি- প্রথমটি সে ইফতার করার সময়, দ্বিতীয় আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়। সিয়ামের মাসে এত বেশি কল্যাণের কারণ আসল উদ্দেশ্য বাদ দিয়ে এর ফজিলতগুলোকে আলাদা করে চিন্তা, উপলব্ধি ও পালন করে প্রকৃত অর্থে এর আসল উদ্দেশ্য হাসিল করা অসম্ভব নয় কি! উসমান ইবনে আবুল আস (রা.) বর্ণনা করেন : আমি রাসুল (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, যুদ্ধের সময় তোমাদের কাছে যেমন ঢাল থাকে তোমাদেরকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য, রোজা তোমাদের জন্য তেমনি ঢাল যা জাহান্নাম থেকে তোমাদের রক্ষা করবে। (তারগিব ও তারহিব) আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (ﷺ) বলেছেন : যে ব্যক্তি (অর্থাৎ সফর, অসুস্থতা ইত্যাদি) কারণ ছাড়া রমজানের একটা রোজা রাখল না, সে যদি তা পূরণের জন্য জীবনভর রোজা রাখে, তাহলেও ওই একটি রোজার ক্ষতি পূরণ হবে না।(তিরমিযি, আবু দাউদ)
অন্য হাদিসে আছে, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য রমজানের রোজা ফরজ করেছেন এবং আমি তাকে তারাবি পড়ার নিয়ম চালু করেছি। সুতরাং যারা ঈমান ও ইহতিসাবের সঙ্গে (আখিরাতে প্রতিফল পাওয়ার আশায়) রমজানের রোজা রাখবে এবং তারাবি পড়বে, তারা গুনাহ থেকে এমনভাবে পাক হয়ে যাবে, যেভাবে তারা জন্মের সময় গুনাহ থেকে পাক ছিল। (তারগিব) যুগে যুগে নবী-রাসুলগণ ওহী লাভের আগে ও পরে বিভিন্ন সময় রোজা পালন করেছেন। হজরত মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে আল্লাহর কাছ থেকে তওরাত পাওয়ার আগে ৪০ দিন পানাহার ত্যাগ করে মানবজীবনের বহু ঊর্ধ্বে আরোহণ করেছেন। হজরত ঈসা (আ.) ইনজিল পাওয়ার আগে ৪০ দিন অনুরূপ সাধনা করেছেন। হজরত আদম (আ.) থেকে হজরত নুহ (আ.) পর্যন্ত চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে রোজা ফরজ ছিল। তাকে আইয়্যামে বিজ রোজা বলা হতো। ইহুদি-খ্রিস্টানদের ওপর রোজা ফরজ ছিল। প্রাচীন সেমাইট, রোমক, ব্যাবিলনীয়, আসিরীয়, জৈন, জয়থস্ত্রীয় প্রভৃতি জাতির মধ্যে রোজার প্রচলন ছিল। এখানে উল্লেখ্য, ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মে চিন্তার বিভিন্নতা নিয়ে তারা রোজা পালন করত। কেউ কেউ এক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির নীতিও অবলম্বন করে থাকে। যেমন ইহুদিরা সপ্তাহব্যাপী উপবাস থাকে, খ্রিস্টানরা সূর্যাস্তের অনেক পর আহার গ্রহণ করে। কিন্তু ইসলামই একমাত্র ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা, সাহরি ও ইফতারের নির্দিষ্ট সময় অনুসরণ করে চলছে।
মানুষের নৈতিক সত্তার বিকাশ সাধনে সৃষ্টির আদি থেকে দুটি বিষয় বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য দায়ী, তা হলো- এক. উদরপূর্তি বা ভোগবিলাস, দুই. নারী সম্ভোগ ও অতি আরামপ্রিয় উচ্চাভিলাষী মনোবৃত্তি। আর যদি লাগামহীনভাবে এগুলো চরিতার্থ করার মানসিকতা গড়ে ওঠে তাহলে মানব সমাজে মহাবিপর্যয় দেখা দেয়। আজকের পাশ্চাত্য সমাজ তারই প্রমাণ। দায়িত্বহীনতা ও কর্তব্যপরায়ণতার গন্ডি থেকে মানুষ বের হয়ে মারামারি, হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, সন্ত্রাস, রাহাজানি, খুন, অশ্লিলতা ও বেহায়াপনায় লিপ্ত হয়। অথচ আল্লাহ তায়ালা পৃথিবী বাসোপযোগী করে সমাজ সভ্যতা গড়ার নিমিত্তে মানুষ তৈরি করেছেন। আমাদের পাশবিক প্রবৃত্তি দমনের জন্যই রোজা প্রবর্তন করা হয়েছে। আর ধনী-গরিবের সেতুবন্ধের নিমিত্তে যাকাত ফরজ করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন, আমাদের নামাজ কায়েম করার এবং যাকাত দেয়ার হুকুম করা হয়েছে। যে ব্যক্তি নামাজ পড়ে কিন্তু যাকাত দেয় না, তার নামাজ আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে না। অন্য এক বর্ণনায় আছে, সে ব্যক্তি মুসলমান নয়। তার আমল কিয়ামতে তাকে কোনো ফল দেবে না। (তাবরানি) আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যখন তুমি তোমার সম্পদের যাকাত (যা তোমাদের ওপর ফরজ) আদায় করে দিলে, তখন তুমি আল্লাহর হক আদায়ের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হলে। আর যে ব্যক্তি হারাম সম্পদ সঞ্চয় করল এবং তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করল, সে তার জন্য কোনো প্রতিদান পাবে না, বরং এর জন্য তার গুনাহ হবে। (ইবনে খোযায়মা, ইবনে হিব্বান)
রমজানের উদ্দেশ্য বর্ণনা প্রসঙ্গে সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও চিন্তাবিদ শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী বলেন, যেহেতু পাশবিক বাসনার প্রাবল্য ফেরেশতা সুলভ চরিত্র অর্জনের পথে অন্তরায়, তাই এই উপকরণগুলোকে পরাভূত করে পাশবিক শক্তিকে আয়ত্তাধীন করাই হচ্ছে এর আসল তাৎপর্য। তাছাড়া রোজার বাহ্যিক কল্যাণও কম নয়। মানবদেহ একটি যন্ত্রের মতো। রোজার মাধ্যমে পাকস্থলীর বিশ্রাম, কর্মদক্ষতা বাড়ে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, এই মাসে উপবাসের কারণে মানুষ অনেক বড় রোগ থেকে মুক্তি পায়।
আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : আল্লাহ প্রতিটি জিনিসের অপবিত্রতা দূর করার জন্য কোনো না কোনো বস্তু সৃষ্টি করেছেন। শরীরকে পরিশুদ্ধ করার বস্তু হলো রোজা, আর রোজা হলো অর্ধেক সবর। (ইবনে মাজাহ) একাদশ শতাব্দীর প্রখ্যাত মুসলিম চিকিৎসাবিদ ইবনে সিনা তার রোগীদের তিন সপ্তাহব্যাপী উপবাস পালনের নির্দেশ দিতেন। তিনি সিয়ামকে সিফিলিস এবং বসন্ত রোগের বিশেষ ওষুধ মনে করতেন। ফরাসি বিপ্লবের সময় মিসরের হাসপাতালগুলোতে সিয়াম পালনই ছিল সিফিলিস রোগের অমোঘ ওষুধ। ড. জুয়েলস এমডি বলেন, যখন একবেলা খাদ্য বন্ধ থাকে তখনই দেহ সেই মুহূর্তটাকে রোগমুক্তির সাধনায় নিয়োজিত করে। ড. ডিউই বলেন, জীর্ণ এবং ক্লিষ্ট রোগীর পাকস্থলী থেকে খাদ্যদ্রব্য সরালে রোগী উপবাস থাকছে না, সত্যিকারভাবে রোগটি উপবাস থাকছে। তাই রোজা মুসলমানদের চিন্তায় ও কর্মে তথা লেনদেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, প্রত্যেকটি কাজ সার্বক্ষণিক আল্লাহর উপস্থিতির পয়দা করে। জীবনের প্রত্যেকটি দিক ও বিভাগ আল্লাহর আইন মোতাবেক সমস্যার সমাধানের অন্যতম শিক্ষাই গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু শুধু না খেয়ে থাকাই আসল টার্গেট নয়।
রাসুল (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, “রোজা রেখে কেউ যদি মিথ্যা কথা বলা ও তদনুযায়ী কাজ করা ছেড়ে না দেয় তবে শুধু খাদ্য পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। রোজার উদ্দেশ্য হলো ক্রোধ, লোভ, মিথ্যা, অন্যায়, অবিচার, ত্যাগ করানো। মায়া, মমতা, আত্মত্যাগ, ন্যায়নীতি, সংযত ইনসাফ, সমবেদনা, মাখলুকের সেবা একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদত করার যোগ্য করে নিজেকে গড়ে তোলা। এর মধ্য দিয়ে পয়দা হয় ভয় ও আমানতদারি। ফলে সমাজের সুখ-সমৃদ্ধি, সুশৃঙ্খলতা, উন্নতির ধারা সূচিত হয়। নামাজ রোজার হাকিকত বইতে সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী (রহ.) লিখেছেন- “রোযার অসংখ্য নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক সুফল রয়েছে। তার মধ্যে আত্মসংয সৃষ্টি অন্যতম। মানুষের খুদী আত্মজ্ঞান যখন তার দেহ এবং অন্যান্য শক্তিসমূহকে পরিপূর্ণরুপে আয়ত্তাধীন করে নিতে পারে এবং মনের যাবতীয় কামনা-বাসনা ও আবেগ-উচ্ছাসকে নিজের সিদ্ধান্তের অধীন ও অনুসারী করে তুলতে পারে, ঠিক তখনই হয় আত্মসংযম।
রোযা তাকে সম্বোধন করে বলে- আজ তোমার মালিক মহান আল্লাহ তোমার যৌনক্ষুধা চরিতার্থ করার ওপরে-বিধি-নিষেধ আরোপ করেছেন। সুবহে সাদেক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিতান্ত হালাল উপায়েও নফসের লালসা-বাসনা পূর্ণ করা তোমার জন্য হারাম করে দিয়েছেন। সে আরও বলে দেয় যে, সারাদিনের দু:সহ ক্ষুধা পিপাসার পর যখন তুমি ইফতার করবে, তখন তুমি পরিশ্রান্ত হয়ে আরাম করার পরিবর্তে ওঠে এবং অন্যান্য দিনের চেয়েও বেশী ইবাদাত কর। এটা কেবল একদিনেরই অনুশীলন নয়, এ ধরনের ট্রেনিং এর জন্য মাত্র একটি দিন কাটিয়েই যথেষ্ট নয়। ক্রমাগত নিরবচ্ছিন্নভাবে দীর্ঘ ৩০টি দিন মানুষই মানুষের খুদীকে এমনি ট্রেনিং ও অনুশীলনের মধ্যেই অতিক্রম করতে হয়। বস্তুত এ শক্তি মানুষের অভ্যন্তরে মানুষের খুদীতে সৃষ্টি করাই রোযার প্রকৃত উদ্দেশ্য। যে ব্যক্তি রোযা রেখেও এ শক্তি লাভ করতে পারে না, সে নিজেকে ক্ষুধা-পিপাসায় পরিশ্রান্ত ও জর্জরিত করেছে। তার উপবাস ও পানাহার পরিত্যাগ একেবারে নিষ্ফল। কুরআনে বলা হয়েছে যে, তোমাদের মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যেই তোমাদের ওপর রোযা ফরয করা হয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা এবং মিথ্যা কাজ করা পরিহার করতে পারলো না, তার পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনোই আবশ্যকতা নেই তিনি আরো বলেছেন যে, অনেক রোযাদার এমন আছে, যারা রোযা হতে ক্ষুধা-পিপাসার ক্লান্তি ভিন্ন আর কিছুই লাভ করতে পারে না।”
মহান আল্লাহ তায়ালা যে উদ্দেশ্যে মানুষকে তাঁর প্রতিনিধি বানিয়েছেন সেই প্রকৃত উদ্দেশ্যই পরিগ্রহ হয়। রমজানের আসল মর্যাদা হলো এ মাসে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে মানবতার হেদায়েত ও মুক্তির জন্য। এ মাসের ক্বদরের রাতে আল্লাহ কোরআন অবতীর্ণ করেছেন যাকে ‘আলফে শাহার’ হাজার মাসের চাইতেও উত্তম বলে অভিহিত করা হয়েছে। যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ক্বদরের রাত ইবাদত করবে তার আগে করা গুনাহগুলো মাফ করে দেয়া হবে। (আল হাদিস) আল্লাহ বলেন : রমজান মাস যে মাসে কোরআনুল কারিমকে নাজিল করা হয়েছে যা মানুষের জন্য নির্দেশাবলি এবং উজ্জ্বল হেদায়েত ও সত্য এবং মিথ্যার পার্থক্যকারী। রমজান মাসে আল্লাহ কোরআন নাজিল করে এ মাসের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। আর যে মানুষগুলো ওই মহাগ্রন্থ আল কোরআনের আলোকে নিজেদের গড়ে তুলবে আল্লাহ তায়ালা গোটা পৃথিবীর সামনে তাদের মর্যাদা সমুন্নত করবেন। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের আলোকে চলা ও কোরআনের আইন সমাজ এবং রাষ্ট্রে বাস্তবায়নের একজন সৈনিক হিসেবে আল্লাহ তায়ালা ব্যক্তিকে প্রশিক্ষিত করার জন্য রোজা ফরজ করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে সত্য এবং মিথ্যার যে চিরন্তন দ্বন্দ্ব তথা কোরআন যে ফোরকান, এর প্রমাণও এই মাসের ১৭ রমজানের ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য তারই সাক্ষ্যবহন করে।
সুতরাং সত্য পথের পথিকদের রয়েছে বিরাট সম্মান ও মর্যাদা। হজরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, অপর একটি দীর্ঘ হাদিসের শেষাংশে রাসুলে করিম (ﷺ) বলেন, ‘আল্লাহর রাহে মুজাহিদের উদাহরণ সেই ব্যক্তির মতো যে রোজাও রাখে, রাতে নামাজও পড়ে এবং কালামে পাক তেলাওয়াত করে। কিন্তু রোজায় সে কাতর হয় না, নামাজেও তার শৈথিল্য আসে না। ফিরে না আসা পর্যন্ত আল্লাহর পথে জিহাদকারীর অবস্থাও অনুরূপ থাকে।’ (বুখারী, মুসলিম, নাসায়ি, ইবনে মাজা ও তিরমিযি) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, ‘নবী করিম (ﷺ) বলেছেন, সারা দুনিয়ার মানুষ আমার হয়ে যাওয়ার চেয়ে আল্লাহর রাস্তায় মৃত্যুবরণ করা আমার কাছে অধিক প্রিয়।’ (নাসায়ি) আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন যারা সারিবদ্ধভাবে সিসা নির্মিত দেয়ালের মতো মজবুতভাবে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে।’
মহাগ্রন্থ আল-কোরআন ও হাদিসের আলোকে আজকের যুগের মুসলমানদের চিন্তা করা উচিত তারা জিহাদ ফি-সাবিলিল্লাহ থেকে কত দূরে। এজন্যই মুসলমানদের আজ করুণ পরিণতি। সুতরাং মানবতার মুক্তি নিশ্চিত করতে হলে যে উদ্দেশ্যে রমজান মাসে মহাগ্রন্থ আল-কোরআন নাজিল করা হয়েছে সে কোরআনের সমাজ বিনির্মাণে আমাদের জান ও মাল উৎসর্গ করতে হবে। সত্যিই এ ধরায় যদি দ্বীন কায়েম হয় তাহলে মানবতার জয়গানে মহীরূহ হবে এই বিশ্বময়। দূর হবে অন্যায়-জুলুম, হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ, উঁচ-নিচুর ভেদাভেদ। আসুন রমজানের প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে, নিজেদের জীবনকে সঠিকভাবে পরিচালিত করার মাধ্যমে সমাজকে আল কোরাআনের আলোয় উদ্ভাসিত করি ব্যাক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে। এটাই হোক মাহে রমযানে মুসলিম উম্মাহর অঙ্গীকার।