বাংলাদেশের মিডিয়া জগতের অত্যন্ত পরিচিত নাম দিগন্ত টেলিভিশন। এই জনপ্রিয় টেলিভিশনের পঞ্চম বর্ষপূর্তিতে দিগন্ত পরিবারকে অভিনন্দন। কিন্তু এই বর্ষপূর্তি আনন্দের নয়। পঞ্চম বর্ষপূর্তি দিগন্ত পরিবার অতিক্রম করছে অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয় আর অশ্রুসিক্ত মনে। অন্যান্য বারের মতো এবারও আমার প্রিয় চ্যানেলদিগন্ত টেলিভিশনের বর্ষপূর্তির একটি দাওয়াতপত্র হাতে পেলাম। ইঞ্জিনিয়ার ইস্কান্দার আলী খান ও শিব্বির মাহমুদ স্বাক্ষরিত এই কার্ডটির ডিজাইনই বলে দিচ্ছে তাদের কষ্ট আর বেদনার কথা। গোটা কার্ডটি কালো রঙে আবৃত, শুধু দিগন্ত টিভির লোগোটা সাদা আকাশে জ্বলজ্বল করছে। মনে হচ্ছে দিগন্ত টিভি অগণিত দর্শক-শ্রোতাকে সে ডেকে ডেকে কিছু বলছে…। বাঁচাও বাঁচাও বলে চিত্কার করছে প্রতিনিয়ত। বিশ্বের অগণিত ভক্ত-অনুরক্তের কাছে উপস্থিত না থাকতে পেরে দিগন্ত টিভি প্রতিটি মুহূর্ত কষ্টের সঙ্গে অতিবাহিত করছে।
এই ক্ষতের বেদনায় আহত বিশ্বব্যাপী অগণিত দর্শক ও শুভান্যুধায়ী। কারণ তারা অনেকদিন যাবত্ প্রিয় টেলিভিশন দেখতে পাচ্ছে না। প্রতিদিনই আমরা অনেক চ্যানেলের অনুষ্ঠান উপভোগ করি। কিন্তু দিগন্ত টিভি না দেখার শূন্যতা যেন কোনোভাবেই দূর হচ্ছে না। দিগন্ত তার নিজস্বতা দিয়ে মানুষের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। ৫ বছর আগে ‘সত্য ও সুন্দরের পক্ষে’ দিগন্ত টিভি যে স্লোগান নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, তার স্থান আজ লক্ষ-কোটি মানুষের হৃদয়ে। সুতরাং আওয়ামী-বাকশালীরা ক্ষমতার জোরে তা বন্ধ করতে পারে, কিন্তু দিগন্ত টিভিকে স্তব্ধ করতে পারবে না। যা সত্য ও সুন্দর, তা জনগণের। ক্ষমতার জোরে মানুষের ভালোবাসাকে বন্দি করা যায় না।
দিগন্ত টিভি এবার তাদের বর্ষপূর্তি উদযাপন করছে প্রতিবাদী কর্মসূচির মাধ্যমে। ২৯ আগস্ট জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদী অবস্থান ও সংহতি বন্ধন। এই প্রতিবাদী কর্মসূচিতে দিগন্তের অগণিত ভক্ত শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকতে না পারলেও মানসিকভাবে উপস্থিত থেকেছেন লক্ষ-কোটি দিগন্তের দর্শক-শুভাকাঙ্ক্ষী। প্রতিবাদ জানিয়েছেন এই অন্যায়ের। আমিও তাদের একজন। কবি আল মাহমুদ হয়তো তার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন ১৯৭৩ সালের ৩০ মার্চ গণকণ্ঠ সম্পাদকের সংবাদ সম্মেলনের কথা। জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দৈনিক গণকণ্ঠ সম্পাদক আল মাহমুদ অভিযোগ করেন : ‘গণকণ্ঠ অত্যন্ত বেআইনিভাবে বন্ধ করিয়া দেওয়ার ফলে তথাকার পৌনে তিনশত সাংবাদিক ও কর্মচারী বেকার হইয়া পড়িয়াছেন। সাংবাদিক অথবা কর্মচারীদের মুহূর্তমাত্র সময় না দিয়া অফিস হইতে কাজ অসমাপ্ত রাখা অবস্থায় বাহির করিয়া দেওয়া হইয়াছে।’ (সূত্র : ইত্তেফাক, মার্চ ৩০ ১৯৭৩) শাপলা চত্বরের অভিযানের সময় গভীর রাতে দিগন্ত অফিসে একই কাণ্ড ঘটিয়েছে মিডিয়াবিরোধী এই আওয়ামী লীগ সরকার। বর্তমানে দিগন্ত, ইসলামিক টেলিভিশন, আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ আর অকুতোভয় সম্পাদক মাহমুদুর রহমান কারাগারের অন্ধকার কামরায় আবদ্ধ। সাগর-রুনিসহ অগণিত সাংবাদিককে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর আওয়ামী-বাকশালীরা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেছে।
সংবাদপত্রকে একটি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সংবাদপত্রের নেপথ্য কারিগর সাংবাদিকরা। তারা অনেক পরিশ্রম করে প্রতিদিন আমাদের সামনে অজানা খবরগুলো নিয়ে আসেন। দেশের উন্নতি-অগ্রগতি এবং আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমাদের সমাজে কিছু ভালো গণমাধ্যম ও সত্ পেশাদার সাংবাদিক না থাকলে আমরা এত দূর আসতে পারতাম না। সংবাদপত্র আমাদের জাতীয় দর্পণ। আমাদের ঐক্যের প্রতীক। কিন্তু শাহবাগিরা! আমাদের জাতি বিভক্তির সর্বনাশা আয়োজন করেছে সেখানে। আমাদের এ কাজের খেসারত দিতে হবে অনেকদিন ধরে। বিশিষ্ট সাংবাদিক শওকত মাহমুদ ‘এ কেমন মিডিয়া?’ শিরোনামে লিখেছেন— নয়া দিগন্ত পত্রিকার অফিস ও প্রেসে আগুন দেয়া হলো। কোনো সাড়া-শব্দ নেই। আজ এসব কুলীন মিডিয়া সাংবাদিকদের মধ্যে অভিজাত ও নিম্নবর্গ শ্রেণী সৃষ্টি করতে চায়। অভিজাত সাংবাদিকদের এক ফোঁটা রক্ত সাধারণ সাংবাদিকের মৃত্যুর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। শাহবাগিরা কী জিঘাংসাই না ছড়িয়ে দিয়েছে!
শাহবাগি তথাকথিত নতুন প্রজন্ম সেই মন্ত্রকেই ধারণ করেছে। ‘জবাই কর’, ‘ফাঁসি চাই’, ‘হামলা কর’, বাতিল কর’, ‘উত্খাত কর’ স্লোগান ছিল মূলত অসাম্প্রদায়িকতা অর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কালো কাপড়ে মোড়ানো পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও মানবতাবিরোধী, জাতিবিনাশী উচ্চারণ। এই নেতিবাচক স্লোগান প্রায় এক মাস ধরে কিছু মিডিয়া অব্যাহতভাবে প্রচার করে সংবাদ মাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। সেই মিডিয়াগুলো শাহবাগি আয়োজকদের ওইসব অপকর্ম প্রকাশ না করে জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বোকা ও বোবা বানিয়ে রেখেছে কোটি মানুষকে। পরিস্থিতি এতই নাজুক হয়ে পড়ল যে, শাহবাগ নামক প্রজন্মের বিরুদ্ধে কথা বললেই রাজাকার, অসভ্য, বর্বর আর সেকেলে। ‘জবাই কর’, ‘ফাঁসি চাই’, ‘হামলা কর’, ‘উত্খাত কর’ স্লোগান অল্প কয়েকদিনের মধ্যে আমাদের উপহার দিল দু’শতাধিক লাশ। এই লাশের দায় কার? উন্মাদনা সৃষ্টিকারী সেই মিডিয়াগুলো কি এর দায় এড়াতে পারবে?
ফাঁসির আসামি বানিয়ে দিল একজন আন্তজার্তিক খ্যাতিসম্পন্ন কোরআনের খাদেম আর ভাষাসৈনিককে। বিভক্ত হয়ে পড়ল গোটা জাতি। কী নির্মম আর নিষ্ঠুর কাজের সহযোগিতা আমরা করলাম!! উপমহাদেশে রাজনৈতিক বিক্ষোভে একদিনে পুলিশের গুলিতে এত মানুষ হত্যার নজির নেই। কতিপয় মিডিয়া এটিকে চিহ্নিত করল সহিংসতা হিসেবে। ভয়ঙ্কর ও বেমানান দিক হলো, মিডিয়া খুন হওয়া মানুষদের পরিচয় নিয়ে খেলেছে অব্যাহত লুকোচুরি। উল্টো যেন লাশকে আসামি বানিয়ে দিচ্ছে এ বলে, এরা জাতীয় পতাকা, শহীদ মিনার, সংখ্যালঘু আর সাধারণ জনতার ওপর হামলাকারী। মিডিয়া বিক্ষোভকে বানালো তাণ্ডব। ধর্মীয় বইপুস্তক কোরআন-হাদিস হলো ‘জিহাদি’ বই। দলীয় মিটিং হলো নাশকতার পরিকল্পনা। শাপলা চত্বরের গণহত্যাকে আড়াল করে বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম সরকারের শেখানো তত্ত্বের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আসছে অব্যাহতভাবে। তার বিপরীতে সত্য ও সুন্দরের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে দিগন্ত মিডিয়া, আমার দেশ পত্রিকা। এই অপরাধে সরকার এই মিডিয়াগুলোর টুঁটি চেপে ধরেছে। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, নিষেধাজ্ঞার কালো মেঘ সরে দিগন্ত টেলিভিশন আবার আলোয় উদ্ভাসিত হবে।