পৃথিবীর বিষ্ময়কর গ্রন্থ আল-কুরআন আল্লাহ তায়ালা এ রমজান মাসেই নাযিল করেছেন। সেই কুরআনকে যারা মনে প্রাণে জীবন বিধান হিসেবে গ্রহন করেছে তারা এ সমাজের মানুষের কাছে আরেক আশ্চর্যের জন্ম দিয়েছে। এ কৃতিত্ব কোন ব্যক্তির নয় স্বয়ং মহা-গ্রন্থ আল-কুরআনের। এ বিষ্ময়কর গ্রন্থ নিয়ে আজ প্রাচ্য-পাশ্চাত্যে গবেষণার শেষ নেই। সবচেয়ে হতবাক করা ব্যাপার সত্যপন্থীদের উপর জেল-জুলুম, নির্যাতন, কারাবরণ, ফাঁসিতে ঝুলানোর মত নির্মম-ভয়ংকর আচরণ করেও যেন দ্বীনী আন্দোলনের কর্মীদের টলানো যাচ্ছেনা ইসলামী আন্দোলনের পথ থেকে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- “এর আগে এমন অনেক নবী চলে গেছে যাদের সাথে মিলে বহু আল্লাহ ওয়ালা লড়াই করেছে। আল্লাহর পথে তাদের ওপর যেসব বিপদ এসেছে তাতে তারা মনমরা ও হতাশ হয়নি, তারা দূর্বলতা দেখায়নি এবং তারা বাতিলের সামনে মাথা নত করে দেয়নি। এ ধরনের সবরকারীদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন।” (৩ঃ১৪৬) সেই পথ ধরে খোলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবায়ে আজমাঈনসহ সকল যুগেই সত্যপন্থীদের পরীক্ষা একই। পরীক্ষার ভিন্নতা যাই হোকনা কেন, বাতিলের বিরোধীতার কারণ এক ও অভিন্ন। স্থান-কাল যতই আলাদা হোকনা কেন বাতিলের জুলুম-নির্যাতন, অপপ্রচার আর কূট-কৌশল যেন একই কারখানায় তৈরী। আল্লাহ তায়ালা বলেন- “ঐ ঈমানদারদের সাথে তাদের শত্রুতার এ ছাড়া আর কোন কারণ ছিল না যে তারা সেই আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিল।” (৮৫ঃ০৩)
একবিংশ শতাব্দীর নব্য জাহেলিয়াতের ধ্বজাধারী স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠীর জেল-জুলুম, অ-মানবিক অত্যাচার-নির্যাতনে ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা আজ একই পরীক্ষার সম্মুখীন। এই পরীক্ষা কোন কারণে আসেনি বরং আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে তা নির্ধারিত। এটি চিরন্তন। এই সত্য কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- “তোমাদের কি এই ধারণা যে, তোমরা জান্নাতে চলে যাবে, অথচ সে লোকদের অবস্থা অতিক্রম করনি যারা তোমাদের পূর্বে অতীত হয়েছে। তাদের ওপর এসেছে বিপদ ও কষ্ট। আর এমনিভাবে শিহরিত হতে হয়েছে যাতে নবী ও তাঁর প্রতি যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে পর্যন্ত একথা বলতে হয়েছে যে, কখন আসবে আল্লাহ্র সাহায্য! তোমরা শোনে নাও, আল্লাহ্র সাহায্য একান্তই নিকটবর্তী।” (২ঃ২১৪)
এ সম্পর্কে হযরত সা’আদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস বলেন, “আমি রাসূল (ﷺ)-কে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! মানুষের মধ্যে সর্বাধিক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হবে কারা? জবাবে তিনি বললেন- “নবীগণ অত:পর তাদের অনুরূপগণ। অত:পর তাদের অনুরূপগণ (অর্থাৎ সম্মানিতগণ, অত:পর সম্মানিতগণ এবং পর্যায়ক্রমে উচ্চ পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিতগণ), বান্দা তার দ্বীনের পরিধি অনুযায়ী পরীক্ষিত হবে। অতএব যদি তারা দ্বীনের ব্যাপারে কঠিন মজবুত হয় তাহলে তার পরীক্ষাও কঠিন হবে, আর যদি সে দ্বীনের ব্যাপারে নরম হয় তাহলে তার দ্বীনের পরিধি অনুযায়ী তাকে পরীক্ষা করা হবে, এভাবে বান্দার নিকট বালা-মুছিবত আসতেই থাকবে (এবং ক্ষমা হতেও থাকবে) যেন সে পাপমুক্ত হয়ে পৃথিবীতে চলতে থাকে। শায়েখ সা’আদী (রহ) বলেন, “আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই স্বীয় বান্দাদের বিপদাপদ দিয়ে পরীক্ষা করবেন এ জন্য যে, যেন সত্যবাদী, মিথ্যাবাদী এবং ধৈর্যশীল ও ধৈর্যহারা ব্যক্তির মধ্যে সুস্পষ্ট প্রমাণ পরিলক্ষিত হয়। (ইমাম তিরমিযী ও ইমাম ইবনু মাজাহ)
সম্প্রতি আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন বিশ্বনন্দিত ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম সিপাহসালার আমাদের প্রিয় নেতা শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। কুরআনের এ দা’য়ী ছিলেন অসংখ্য আলেম ও ইসলাম প্রিয় জনগণের রুহানি উস্তাদ। ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র, মার্জিত, পরিশীলিত, মৃদুভাষী এক অসাধারণ ইসলামী ব্যক্তিত্ব। নরমদিল, অমায়িক ব্যবহার, ও স্বচ্ছ চিন্তার অধিকারী, সরল জীবন-যাপনে অভ্যস্ত এই মানুষটি কখনো কারো সাথে রূঢ় আচরণ করেছেন কিংবা কাউকে সামান্য কোন কটু কথা বলে আঘাত দিয়েছেন এমন কোন নজির নেই। সুদীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছরের রাজনৈতিক জীবনে দেশবাসীর কল্যাণে নিবেদিত মাওলানা নিজামীর ব্যক্তিত্ব দেশবাসীর হৃদয়ে তাদের প্রিয় নেতা স্থান করে নিয়েছেন। তিনি ছিলেন দূর্নীতিমুক্ত ও ইনাসফভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের সংগ্রামে অগ্রসেনানী। শুধুমাত্র ইসলামী আন্দোলন করার অপরাধে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।
পৃথিবীর সব নীতি-নৈতিকতা, শিষ্ঠাচার, ন্যায়বিচার কে উপেক্ষা করে রক্তপিপাসু হায়েনারা বিচারের নামে প্রহসন করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হত্যা করেছে আল্লাহর একজন প্রিয় বান্দাহকে। যিনি সারা জীবন মানুষকে আল্লাহর দ্বীনের দিকে আহবান করেছেন। একটি সুখি সমৃদ্ধশালী, কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তাঁর সততা, দক্ষতা, দেশপ্রেমের ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত জাতি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। জুলুম-নির্যাতন, অন্যায়-অবিচারের পথ পাড়ি দিয়ে দ্বীনের মর্দে মুজাহিদ জাতির সামনে এখন ধৈর্য্য ও ইনসাফের প্রতিক।
সারা জীবন অন্যায়ের সামনে মাথা না নোয়াবার যে দীক্ষা তিনি দিয়েছেন জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত তা পালন করেছেন অক্ষরে-অক্ষরে। বাতিলের কোন চক্রান্ত, ষড়যন্ত্রই তাঁকে কাবু করতে পারেনি। শহীদ মাওলানা নিজামী এখন ১৬ কোটি মানুষের দূরান্ত সাহসের বাতিঘর। যারা তাঁকে স্বাধীনতা বিরোধী বলে ফাঁসি দিয়েছে তারা নিজেরাও স্বীকার করবেন এ হত্যা শুধু রাজনৈতিক কারণেই। এদেশের তরুন প্রজন্ম শহীদ নিজামীকে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করবে। শহীদ নিজামীর বিদায়ে হৃদয়ে রক্তক্ষরন আর অব্যক্ত বেদনায় অশ্রু বিসর্জিত হচ্ছে। পৃথিবীর শতাধিক দেশে তাঁর গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এমন সৌভাগ্য কেবল শহীদদেরই।
”তিবরানীতে হযরত মুয়াজ বিন জারুন (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীস যাতে বলা হয়েছে যে, ইসলামের রাজনৈতিক অবস্থা যখন বিকৃত হয়ে যাবে, তখন বিপথগামী শাসকরা কর্তৃত্বশীল হবে এবং তারা সমাজকে ভ্রান্ত পথের দিকে নিয়ে যাবে। তাদের নির্দেশ মেনে চললে জনগণ গোমরাহ হয়ে যাবে। আর তাদের নির্দেশ অমান্য করলে তারা তাদের হত্যা করবে। এ কথা শোনার পর লোকেরা জিজ্ঞেস করলো তারপর তারা কি করবে, তিনি বললেন : সে সময়ে তোমাদেরকে হযরত ঈসার সহচরগণ যা করেছিল তাই করতে হবে। তাদেরকে করাত দিয়ে চিড়ে ফেলা হয়েছে। শূলে চড়ানো হয়েছে, তবুও তারা বাতিলের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি।
কিন্তু যার জন্য এত ফরিয়াদ রোনাজারি আহাজারি তিনি ছিলেন শাহাদাতের পূর্ব পর্যন্ত নি:শ্চল, অটল এবং অবিচল। তাঁর মধ্যে ছিলনা কোন উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা। বরং কারাগার থেকে দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করলেন-“জীবন-মৃত্যুর মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। মহান আল্লাহ আমার মৃত্যুর জন্য যে সময় ও স্থান নির্ধারণ করে রেখেছেন ঠিক সে সময় এবং সে স্থানেই আমার মৃত্যু হবে। তার আগেও নয়, পরেও নয়। আমার মাঝে কোন দূর্বলতা নেই। আমি কোন অন্যায় করিনি। আল্লাহ যদি আমাকে শহিদী মৃত্যু দেন তাহলে সেটা হবে আমার চরম সৌভাগ্য”।
শহীদ নিজামীর বিরুদ্ধে আনা এ সবই কাগুজে অভিযোগ। যিনি এ সমাজেই বেড়ে ওঠা সর্বজন শ্রদ্ধেয় জাতীয় ব্যক্তিত্ব খেতাবে ভূষিত। এদেশের জনগণ কখনো তাঁকে ভূলবেনা। অর্ধ শতাব্দী কাল যিনি এ যমীনে আল-কুরআনের আহবান পৌছিয়েছেন দেশের প্রতিটি প্রান্তে-প্রান্তে। মানবতার সেবায় যে জীবন নিয়োজিত করেছেন আর তাঁকে হত্যা করা হয়েছে মানবতা বিরোধী কর্মকান্ডের জন্য!! কি সেলুকাস এ পৃথিবী! কি অদ্ভুত আর বিষ্ময়কর আমাদের রাজনীতি! কত নিষ্ঠুর, নোংরা, কলুষিত, ক্ষমতার মোহে দিকভ্রান্ত আওয়ামীলীগের এই নেতিবাচক শিষ্টাচার বহির্ভূত অ-পরাজনীতিকে! ধিক।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর যে ব্যক্তি জেনে বুঝে কোন মুমিনকে হত্যা করে, তার শাস্তি হচ্ছে জাহান্নাম। সেখানে সে চিরকাল থাকবে। তার ওপর আল্ল¬াহর গযব ও তাঁর লানত এবং আল্লাহ তার জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন।” (৪:৯৩) আজ শহীদ নিজামী হয়ে আছেন অমর! আর হত্যাকারীরা জাহান্নামকেই নিজেদের ঠিকানা বানিয়ে নিয়েছে। যুগের পর যুগ শতাব্দীর পর শতাব্দী দুনিয়া বাসী খুনিদের অভিশাপ দিতে থাকবে।
আল্লাহর প্রিয় বান্দা, মর্দে মুজাহিদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করার প্রেরণায় কতটা ব্যাকুল ছিলেন, তা এখান থেকেই স্পষ্ট বুঝা যায়। পরিবারের সাথে শেষ সাক্ষাতের সময় সবাইকে নিয়ে মোনাজাত শেষে মাওলানা নিজামী তাঁর ছেলে ব্যারিস্টার নাজিব মোমেনকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি ফাঁসির মঞ্চে লুঙ্গি পরে না পাঞ্জাবি-পাজামা পরে যাবেন? মোমেন বললেন, পাঞ্জাবি-পাজামা পরে যাবেন। পরিবারের সদস্যদের বিদায় দিয়ে মহান রবের পানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন মাওলানা নিজামী। জল্লাদরা যখন তার কক্ষের সামনে যায়, তিনি বললেন, ‘আমি প্রস্তুত’। কখন ফাঁসি কার্যকর হবে? এখানেই শেষ নয়, ফাঁসির মঞ্চে ওঠে ফাঁসি কার্যকরের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর একত্বের ও রিসালাতে মুহাম্মদীর সাক্ষ্য “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ” উচ্চস্বরে উচ্চারণ শেষ হলে সর্বশেষ মাবুদের দরবারে তাঁর আকুতি ছিলো, “হে আল্লাহ আমাকে শহীদ হিসেবে কবুল করে নিন”।
আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছে- “যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে তোমরা মৃত মনে করো না, তারা আসলে জীবিত। নিজেদের রবের কাছ থেকে তারা জীবিকা লাভ করছে।” (৩:১৬৯) কুরআনী ঘোষণা আর ইসলামের স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাস স্বাক্ষী অত্যাচারের পথ ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দ্বীনের মজবুত ঘাঁটি। কারণ কোন ব্যাক্তিকে হত্যা করে আদর্শকে হত্যা করা যায়না। বরং আদর্শ নতুন উজ্জীবনী শক্তি নিয়ে এগিয়ে যায় দূর্বার গতিতে। হৃদয়ের শোক আর সঞ্জিত শক্তি রূপ নেয় অপ্রতিরোধ্যতায়। যে জমিন শহীদের রক্তে রঞ্জিত সেখানে ইসলামের বিজয় তত অনিবার্য সত্য।
পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানব নবী-রাসূলগণের জন্য দুনিয়াকে আল্লাহ আরামদায়ক আবাস বানাননি। নবী করীম (ﷺ) বলেছেন- “দুনিয়া মুমিনের জেলখানা ও কাফেরের জান্নাত” তিনি আরো বলেন-আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে তিনি নানান সংকট দ্বারা জর্জরিত করেন। কিন্তু প্রতিটি অধ্যায়ে তারা ছিলেন আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলকারী এবং তাঁরই সাহায্যের মুখাপেক্ষী। আজকের দিনে সত্যের পথের পথিকদের ও একই পথ অনুসরণ করেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
যারা তাওয়াক্কুলের নীতি অবলম্বনকারী, তারা কখনো হতাশ হয়না। আশা ভঙ্গে কখনও মুষড়ে পড়ে না। বিপদ-মুসীবত, যুদ্ধ-সংকটে ঘাবড়ে যায়না। যে কোন দূর্নিপাক, দূর্যোগ, সংকট আর পরীক্ষায় আল্লাহ তায়ালার উপর দৃঢ় আস্থা রাখে। ঘোর অন্ধকারে আশা করে উজ্জল সুবহে সাদিকের। আল্লাহ বলেন- “প্রকৃত কথা এই যে, সংকীর্ণতার সাথে প্রশস্ততাও রয়েছে।” (৯৪:৫) যত জুলুম-নির্যাতন অত্যাচার, নির্যাতন-নিপীড়নের ঝড়-তুফান আসুক না কেন কোনো অবস্থাতেই আল্লাহ ব্যতিত কাউকে ভয় করা যাবে না। আল্লাহর ঘোষণা- “সত্য সমাগত মিথ্যা অপসৃত, সত্যের বিজয় অবশ্যম্ভাবী।”
মিশরের নীল নদের তীরে আজ থেকে অর্ধশতাব্দী পূর্বে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছিল সাইয়েদ কুতুব, হাসান আল বান্না, আব্দুল কাদের আওদাহ সহ ইসলামী আন্দোলনের অসংখ্য মর্দে মুমীনকে। অনেকেই ভেবেছিল এখানেই বুঝি শেষ। কিন্তু না। সে শহীদী বিত্তের অববাহিকা তূফান তুলছে গোটা আরব বিশ্বে। বৃটেনের টেমসের কিনার হতে আমেরিকা পর্যন্ত এই শহীদি রক্তের জোয়ার প্রভাবমান। আরব বসন্ত স্বৈরাচারকে বিদায় দিয়ে ক্ষমতায় আরোহিত হয় ড. মুরসীর দল ইখওয়ানুল মুসলেমেীন। ড.বাদী সহ এখন আঠার হাজার নেতা-কর্মী পরীক্ষার মুখোমুখি। কিন্তু তাদের সাহস, উদ্দীপনা, বক্তব্য সবাইকে হতবাক করেছে। ফাঁসির রায় শুনে ড. বাদী ও ড. মুরসী বলেছেন, “এক হাজার বার ফাঁসি দিলেও আমরা এ পথ থেকে সরবোনা।”
এমন কথা ক্ষমতা-লোভী, দুনিয়া পুজারী কোন মানুষের পক্ষে উচ্চারণ করা অসম্ভব। এমন দৃঢ়তা কেবল তারাই দেখাতে পারে যারা আল্লাহ ছাড়া কারো কাউকে ভয় করেনা। কেবল মাবুদের সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কিছু চিন্তাই করেনা। ক্ষমতার এমন পটপরিবর্তনে অনেকে গবেষক-বিশ্লেষকই কাগজ-কলম নিয়ে বসে যাবেন। তাদের কি কি ভূল ছিল! তাদের কাছে প্রশ্ন ইখওয়ানের মত একটি আধুনিক, চৌকস দলের নেতারা কেন ক্ষমতাচ্যুত হলেন?
মিশরের ইখওয়ানতো স্বাধীনতার স্বপক্ষের প্রধানতম দল হিসেবে সে দেশে বিবেচিত। পোশাকে-আশাকে, শিক্ষা-দীক্ষায়, সেক্টর ভিত্তিক লোক তৈরিতে তারা কমপারদর্শী নয়। তাহলে এটিকে কোন বিপর্যয় বলবেন? হ্যাঁ মানুষ ত্রুটি-বিচ্যুতির উর্ধ্বে নয়। তবে আসল সত্য হলো, এটি হচ্ছে সত্য-মিথ্যার চিরন্তন লড়াই। কিন্তু একথা সত্য ড. মুরসীকে জালিমেরা ফাঁসি দিলেও মিশরে ইখওয়ানের বিজয় হবে এবং তারা আবার মিশর শাসন করবে ইনশাল্লাহ।
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে বাংলাদেশেই প্রথম সর্ববৃহৎ ইসলামী আন্দোলনের প্রধান সহ শীর্ষ নেতাদেরকে ফাঁসি দিয়ে আওয়ামীলীগ ইতিহাসের ন্যাক্কারজনক ও মার্জনীয় অপরাধ করলো। দলের অন্য নেতারাও সরকারের দমন-নিপীড়নের কারণে প্রকাশ্যে আসতে পারছেনা। হাজার-হাজার নেতা-কর্মী কারাগারে। অনেকেই আহত ও পঙ্গু। লক্ষ-লক্ষ নেতা-কর্মী ঘর-বাড়ী ছাড়া। তবুও দলটি কিভাবে পরিচালিত হচ্ছে? এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে-খুঁজতে অনেকে হয়রান। প্রায় ৬ বছর দলীয় অফিস বন্ধ। শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কেউই বাহিরে নেই। জামায়াতকে নিয়ে একশ্রেণীর মিডিয়ার ঘুম নেই। তারা মনে করেছে, জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের হত্যা করলেই জামায়াত শেষ হয়ে যাবে। নেতা-কর্মীদের মনোবল ভেঙে যাবে। জামায়াতের কিছু-কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ করলেই সব তছনছ হয়ে যাবে। তাই তারা প্রতিদিনই অনেক অসত্য, আজগুবি, কাল্পনিক, রিপোর্ট প্রকাশিত করছে। কেউ জামায়াতের মুখপাত্র নেই বলে তিরস্কার করছেন। কেউ আজগুবি কল্পকাহিনী তৈরি করে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। এসব লিখে জামায়াতকে নিয়ে আন্ডার ইষ্ট্রিমিট ও অভার ইষ্ট্রিমিটি কোনটিই যেন থেমে নেই।
আওয়ামীলীগ মনে করেছিল নিবন্ধন বাতিল করলেই জামায়াতের নিশানা মুছে যাবে। কিন্তু দেখা গেল উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন নির্বাচনে অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় ভালো ফলাফল করেছে জামায়াত। তার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নির্বাচিত সদস্য নারী। তাহলে কি জয়ের বোরকা বিরোধী মিশন পরাজিত হলো? লতিফ সিদ্দিকী বোরকা ও হজ্জের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে জনতার রোষানলে পড়ে মন্ত্রীত্ব পর্যন্ত হারালেন। তাহলে সেই মিশনও কি ব্যর্থ নয়? আসলে এদেশের মানুষ ইসলাম বিরোধী কোন কাজই সমর্থন করেনা।
আবার অনেক গবেষকরা কাগজ-কলম নিয়ে গবেষণা করছেন, কি ভুলের কারণে জামায়াত নেতাদের ফাঁসি আর আজকের এই বিপর্যয়। কি কি কাজ না করলে জামায়াত এমন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতো না। কার সাথে জোট বাধলে আর না বাধলে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না। এ পর্যালোচনায় লিপ্ত। আবার অনেকে কর্মীদের মনোবল দূর্বল করার জন্য বিভিন্ন কায়দা-কানুন আর বুদ্ধিভিত্তিক শব্দচয়নের মাধ্যমে আঘাত হানার চেষ্টাও করছেন অনবরত।
অনেকেই আমাদের শক্তির উৎস খোঁজেন। এ আন্দোলনের শক্তির উৎস আল্লাহর সাহায্য। জনগণের দোয়া ও ভালোবাসাই আমাদের আসল পাথেয়। কুরআন ও সুন্নাহ আমাদের পরিস্থিতি মোকাবেলার হাতিয়ার। সুতরাং বাতিলের ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত দেখে হতাশ না হয়ে মুমিন বান্দার উচিত আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার জন্য গুণাবলী অর্জনে সচেষ্ট হওয়া। আল্লাহ বলেন- “আর তোমরা নিরাশ হয়ো না এবং দুঃখও করো না। যদি তোমরা মুমিন হও তবে, তোমরাই জয়ী হবে।” (৩:১৩৯)
ইসলামী আন্দোলনের উপর জুলুম নির্যাতন যত বেশি আসবে আন্দোলন তত মজবুত ও শক্তিশালী হবে। কুরআনে বলা হয়েছে- আর তাদের মোকাবিলায় তোমরা দৃঢ়তা, অবিচলতা ও মজবুতি দেখাবার ব্যাপারে পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা করো। (৩:২০০) তাই যুগে-যুগে মর্দে মুজাহিদদের সাহসী উক্তিগুলো দুনিয়াবাসীকে প্রেরণা যোগাতে থাকবে শতাব্দীর পর শতাব্দী। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এমন সাহসী উচ্চারণ ও দৃঢ়তা কেবল আল্লাহর উপর ভরসাকারী ঈমানদারগণই দেখাতে পারেন। আমরা দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করি শহীদের রক্ত আর মজলুমের চোখের পানি বৃথা যাবে না। সকল ত্যাগের বিনিময়ে বিজয় অর্জিত হবেই ইনশাল্লাহ। মুমীনের জন্য আল্লাহর সাহায্য খুবই নিকটবর্তী।
সুতরাং চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্র করে ইসলামী আন্দোলনকে পরাভূত করা যাবেনা। আল্লাহ বলেন- “এ চক্রান্ত তো তারা করলো এবং তারপর আমি একটি কৌশল অবলম্বন করলাম, যার কোন খবর তারা রাখতো না।” (২৭:৫০) তাই মুমিনদের উচিৎ আল্লাহর উপর তায়াক্কুল করে সাহায্য পাওয়ার উপযুক্ততা অর্জনে সচেষ্ট হওয়া। আতœপর্যালোচনার মাধ্যমে নিজেদের ভুলত্রুটি সংশোধন ও দূর্বলতা দুরীকরণ এবং সুদূর প্রসারী পরিকষ্পনা নিয়ে সামনের দিকে দৃঢ় কদমে অগ্রসর হওয়া। কাজেই বাতিলের অমানবিকতা ও সমাজের বিকৃতি দেখে অশ্রুপাত নয়। পরিস্থিতির কাঠিন্যতায় দিকভ্রান্ত প্রতিকের মত শুধু হা-হুতাশ, হীনমন্যতা নয়। জটিল-জটিল তত্ত্ব আর তথ্যের ফুলঝুরি দিয়ে কি করা ঠিক হয়েছে, আর কি করা ঠিক হয়নি, এমন সমালোচনা, দোষারোপ আর অতিকথনও নয়। নিজের দূর্বলতা ঢাকতে অন্যের সমালোচনাও নয়। বরং যারাই সমাজ গঠনের চূড়ান্ত আকাঙ্খা হৃদয়ে লালন করেন, ইকামতের দ্বীনের কাজকে ফরজ মনে করেন, তাদেরকে দৃঢ় কদমে সামনে অগ্রসর হতে হবে। কারণ ঈমানের দাবীদার সবাইকে এই কঠিন চুল্লী অতিক্রম করে জান্নাত লাভ করতে হবে। ঈমানদারদের জন্য এর কোন বিকল্প পথ রাখা হয়নি।
ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে কুরআন ও সুন্নাহের যথার্থ জ্ঞানের পাশাপাশি সমসাময়িক-আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও পারদর্শী হতে হবে। দ্বীনের প্রতি অবিচল বিশ্বাস, চরিত্র ও কর্মের মাধ্যমে নিজেদের ময়দানে পেশ করতে হবে। নিছক কোন আবেগ আর উত্তেজনা অথবা কামনা-বাসনার বশবর্তী হয়ে নয় বরং সর্বাবস্থায় দ্বীনকে জীবনোদ্দেশ্য হিসেবে যদি আমরা গ্রহন করতে পারি, বুনিয়ানুম মারছুছ এর মত হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে যদি সম্মুখ পানে অগ্রসর হতে পারি তাহলে দুনিয়া ও আখেরাতে আমরা কামিয়াবি হাসিল করতে পারব ইনশাল্লাহ।
যুগে-যুগে ক্ষমতার মোহ ও দাম্ভিকতার কারণে নমরুদ, ফেরাউন, হিটলার আস্ফালন করেছে। ইতিহাস সাক্ষী এরাও আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে ইনশাল্লাহ। এটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
সর্বশেষ আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ঐতিহাসিক বক্তব্যের কয়েকটি লাইন দিয়ে শেষ করছি-তিনি বলেছিলেন- ”প্রিয় ভাইয়েরা, জুলুমে ভরা বিশ্ব আজ ত্রাণকর্তার অপেক্ষায় আছে। বাংলাদেশের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষও মুক্তির প্রহর গুনছে। এই মুক্তি একটি সফল ইসলামী বিপ্লব ছাড়া সম্ভব নয়। আজকে আমাদের কথার মাধ্যমে, আমাদের কাজের মাধ্যমে, আমাদের চাল-চলন, আচার-ব্যবহারের মাধ্যমে, ময়দানে আমাদের জোরালো ভূমিকার মাধ্যমে দেশের মানুষকে এই মহাসত্য উপলব্ধি করাতে হবে। উপলব্ধি তাদের মধ্যে সৃষ্টি করাতে হবে। এক্ষেত্রে আসুন আমরা একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার ওয়াদা আছে- একদল মানুষ যোগ্যতার সাথে, সততার সাথে দেশ, জাতি ও সমাজ পরিচালনার যোগ্য আল্লাহর দৃষ্টিতে বিবেচিত হলে বিশ্বজুড়ে আল্লাহ খেলাফত দিবেন। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভবিষ্যত বাণী আছে- নবুয়াতের পর খেলাফতের যুগ আসার কথা। সেই ভবিষ্যত আলোকে নবুয়াতের পর খেলাফতের যুগ এসেছিলো। খেলাফতের যুগের অবসানের পর মুলুকিয়্যাত বা রাজতন্ত্রের যুগ আসার কথা ছিল সেটাও এসেছে। আজকে দেশের দু-চারটি দেশে যে রাজতন্ত্র আছে তা কয়েকদিনের মেহমান হিসেবে আছে। রাজতন্ত্রের অবসানের পর বিশ্বের দেশে-দেশে যে সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয়ে আছে, যে নামেই ডাকা হোক না কেন তার আসল পরিচয় জুলুমতন্ত্র। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে হোক, জাতীয়তাবাদের নামে হোক, পশ্চিমা গণতন্ত্রের নামেই হোক আর যে নামেই হোক না কেন, রাসূল (ﷺ)-এর ভবিষ্যত বাণীর আলোকে এই জুলুমতন্ত্র ইতিহাসের শেষ কথা নয়। এরও অবসান ঘটবে। এর অবসানের প্রেক্ষাপটে আবার আসবে খেলাফত আ’লা মিনহাজিন নবুয়্যাতের যামানা। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে- এই বর্তমানে বিরাজমান জুলুমতন্ত্রের অবসানের দিনক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে। এরপরেই বিশ্বব্যাপী ইনশাআল্লাহ ইসলাম বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। ইসলামী আন্দোলন বিশ্বব্যাপী আজ ঈমাণের অগ্নিপরীক্ষার একটি স্তর অতিক্রম করছে। এই পরীক্ষায় যারা ফেল করবে তারা ডানে-বাঁয়ে ছিটকে পড়বে। আল্লাহর কিছু বান্দা শাহাদাত বরণ করবে। আর সবর এস্তেকামাতের সাথে ঈমানী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা ময়দানে টিকে থাকবে ইনশাআল্লাহ তাদের হাতেই ইসলামের বিজয় পতাকা অর্পিত হবে।”
লেখক: সহকারী সম্পাদক, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা।