দ্বিতীয় পর্ব:
লক্ষনীয় বিষয় শিবিরের বিরুদ্ধে নাশকতার যত গল্প-ই আটা হোকনা কেন শিবির তার নিজস্ব চরিত্র ও কর্মকান্ডের মাধ্যমে তা রুখে দাড়াতে সক্ষম হয়েছে। এতো হাজার হাজার শিবির নেতা-কর্মী গ্রেফতার হলো কেউ প্রমান করতে পারেনি শিবির ধুমপায়ী, চাঁদাবাজ, মদ, গাজা পেনসিডিলসহ কোন অসামাজিক ও অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই সরকার নিজেই জনগণের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে এগিয়ে দিয়েছে। মানুষের মধ্যে তাদেরকে জানার আগ্রহ ও তাদের আন্দোলনে প্রথম কাতারে নিয়ে এসেছে। এটি তারা আগামীতে সফলভাবে কাজে লাগাবে। তাদের বিরুদ্ধে নেয়া অনেক কর্মকান্ডেই এখন সরকারের জন্য বুমেরাং হচ্ছে। বিগত চার বছর সরকার ও কতিপয় পুলিশ এটা বলে আসছে ছাত্রশিবির রাজপথে গাড়ী ভাংচুর করে এবং আগে পুলিশের উপর হামলা করে। কিন্তু জামায়াত বলছে তাদেরকে গণতান্ত্রিক কর্মসূচী পালনের সুযোগ দিচ্ছেনা সরকার। তারা শান্তিপূর্ন কর্মসূচী পালন করতে চায়। জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারী জেনারেল সংবাদপত্রের মাধ্যমে এমন চ্যালেঞ্জই দিয়েছিলেন। তাছাড়া বগুড়ায় চার নেতা-কর্মী নিহত হবার প্রতিবাদে দেশব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচীর অংশ হিসেবে ২রা ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকায় জামায়াতকে পুলিশ মিছিল করার অনুমতি প্রদান করে। এই শান্তিপূর্ণ মিছিল ছিল “ট্যক অব দ্যা কান্ট্রি” মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী এই মিছিল জনমনে সস্তি এনেছে কিছুটা হলেও। জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির রাজপথে মিছিল করতে দিলেই ভাংচুর আর জানমালের ক্ষতি সাধন করে, পুলিশের এমন অভিযোগে জামায়াতের শান্তিপূর্ণ মিছিল করার মাধ্যমে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
আজ বাংলাদেশ থেকে ইসলামকে সমূলে উৎখাতের হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ও ব্রাহ্মণ্যবাদী গোষ্ঠী এবং তাদের এ দেশীয় এজেন্ট মুসলিম নামধারী কিছু নাস্তিক। তারা মিডিয়া, ব্লগসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আল্লাহ, রাসূল (সা:) সাহাবায়ে কেরাম ও ইসলামের মৌলিক বিধানগুলোর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। শুধু তাই নয়, বামপন্থী নাস্তিক বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শে বর্তমান সরকার এ দেশ থেকে ইসলাম বিতাড়নের দীর্ঘমেয়াদি নীলনকশা বাস্তবায়ন শুরু করেছে। কিছু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া প্রতিনিয়ত ইসলাম, মুসলমান ও আলেম-ওলামাদের হেয় প্রতিপন্ন করার হীন চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। তারা আলেম-ওলামা ও মাদ্রাসার বিরুদ্ধে হরদম মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর সংবাদ পরিবেশন করে জাতিকে বিভক্ত করার অপতৎপরতায় লিপ্ত।
ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিয়ে আওয়ামীলীগের এত মাথাব্যাথা কেন?
শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, হত্যা-খুন, শিক্ষক-ছাত্রী লাঞ্ছনা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তি বাণিজ্যের বিপরীতে ইসলামী ছাত্রশিবির তাদের মেধা, সততা ও দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ছাত্রকল্যাণ ও জনকল্যাণমুলক কাজের মাধ্যমে সাধারণ ছাত্র-শিক্ষকসহ সর্বপযায়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত সরকার পরিচালনায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ দুই নেতার সফল মন্ত্রিত্ব ও নেতা-কর্মীদের নিঃস্বার্থ ও নির্লোভ অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের মানুষ সততা, দক্ষতা ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল নজির প্রত্যক্ষ করেছে। তাদের সফল নেতৃত্ব দেশের মানুষকে আশ্বস্ত করেছে যে আজও দুর্নীতি, অপরাজনীতি, ও অপসংস্কৃতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব। ইসলামী আন্দোলনের এই গ্যারান্টিপূর্ণ চ্যালেঞ্জ দেশে সেক্যুলারপন্থী গোটা শিবিরকে দিশেহারা করে তুলেছে। ফলে দিশেহার আওয়ামী লীগ, বেছে নিয়েছে ইতিহাসের জঘন্যতম নির্যাতনের পথ। প্রতিনিয়ত চলছে হত্যা, গুম, জুলুম, নির্যাতন, গ্রেফতার, হামলা ও মামলা। যুদ্ধাপরাধীদের, বিচারের নামে চলছে নেতৃবৃন্দকে হত্যা করা গভীর ষড়যন্ত্র।
অনেক ত্যাগের মূল্যে কেনা, তবুও থামবেনা……
পৃথিবীর জন্মের পর থেকেই আদর্শের লড়াই অব্যাহত। এই পথে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে সকল নবী রাসুল (স:)-কে। যুগে যুগে যারাই সেই পদাংক অনুসরণ করবে, তাদের প্রত্যেককেই একই পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলন এখন সেই কঠিন সময় অতিক্রম করছে এতে কোন সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদি আওয়ামী লীগ সরকারের সবচেয়ে বেশি জিঘাংসার শিকার হয়েছে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন। ইসলামী ছাত্রশিবিরের গঠনমূলক কর্মকান্ডে তারা শঙ্কিত হয়ে এর নেতা-কর্মী সর্বোপরি নিশ্চিন্হ করার পাঁয়তারা করছে। অন্যায়ভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার পথে প্রধান অন্তরায় বলে তারা মনে করছে ছাত্রশিবিরকে। ফলে দমন-পীড়ন, অত্যাচার-নির্যাতন এবং খুন-জখমের টার্গেটে পরিণত হয়েছে সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। এ নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছে না বাড়িতে থাকা মা বোনেরাও।
আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালাতে গিয়ে গোটা রাষ্ট্র যন্ত্রকেই আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। এই নির্যাতন চালাতে গিয়ে রাষ্ট্রের কর্মকর্তা কর্মচারী একাংশ এই আন্দোলনের নেতা কর্মীদের গোটা জীবনাদর্শ ও একটি ধারণা পেয়েছি। যাদেরকে বলা হচ্ছে বোমাবাজ, নাশকতাকারী সন্ত্রাসী ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে সে ছেলেটি কুরআন হাদীসের অধ্যয়নকারী, তাহাজ্জুত গুজার, অনৈতিকতা, মাদক অসত্য থেকে শুধু নিজেই দূরে থাকেনা বরং গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে এই আদলে সাজানোর জন্য রাতদিন অকাতরে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তাকে বলা হচ্ছে নাশকতাকারী তিনি সমাজের সকল পর্যায় থেকে অনাচার, জুলুম, নির্যাতন, পাপাচার, জাহিলিয়াত দূর করে গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে ছেঁকে একটি আধুনিক সমৃদ্ধ দেশ গড়তে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যাকে বলা হচ্ছে সেকেলে তিনিই জবাবদিহিত চেতনাকে প্রচন্ডভাবে লালন করেন, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা অন্যের অধিকার নষ্ট করা কিংবা সম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল হারামের বিধানকে দারুণভাবে সংরক্ষণ করেন। যে যুবকের গোটা চরিত্র কর্ম ও তৎপর একটি পরিকল্পিত, পরিমার্জিত ও রুচিশীল, আধুনিক সমাজব্যবস্থার নিয়ামক। সে যুবকদের বিরুদ্ধে এমন মিথ্যাচার অনেকের হৃদয়ে রেখাপাত করে।
এই আধুনিক জাহিলিয়াতের মাঝেও এমন মানুষের কল্পনা যেখানে দুরহ মনে হয় সেখানে এই আন্দোলন এমন গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ তৈরি করছে। এই জুলুম নির্যাতনের মাঝেও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালাতে গ্রেফতার করার জন্য খুঁজতে গিয়ে চমৎকার ধারনাটিও পুলিশ, র্যাব, বিভিন্ন বাহিনীসহ অনেকে মনে করেছে আলহামদুলিল্লাহ। এই জন্য সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী বলেছিলেন: “আমরা এই সমাজের মানুষ গুলোকে মুসলমান বানাতে বের হয়েছি। কিন্তু এই কাজে আমরা না যতটুকু সফল হয়েছি তার থেকে আমাদের বড় সফলতা হচ্ছে সমাজের সব মানুষ মিলে আমাদেরকে মুসলমান বানিয়ে দিয়েছে।”
সুতরাং আজ সত্যপন্থীদের জীবনে জেল-জুলুম, নির্যাতন, হত্যা, ফাঁসির রায় এগুলো নতুন হলেও ইসলামী আন্দোলনে তা একেবারেই পুরাতন। আজো পৃথিবীর প্রান্তে-প্রান্তে মুসলমানদের সাথে চলছে একই অচরণ। সারা পৃথিবীতে আজ মুসলমানরা নির্যাতিত। বিশেষ করে সারা দুনিয়ায় আজ জামায়াত ও ইখওয়ান এই দুটি আন্দোলন সবচেয়ে বেশী নির্যাতিত।
বাংলাদেশ আজ কারাগারে পরিণত হয়েছে। দেশের বিরোধী মতের মানুষেরা আজ এই ফ্যাসিষ্ট সরকারের জুলুম-নির্যাতনের আতংকে ভুগছে। কেউ কারাগারে আবদ্ধ থেকে নিজের পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন বছরের পর বছর। আবার কেউবা কারাগারের বাহিরে থেকেও মিথ্যা মামলা, খুন আর গুমের আতংকে দু:সময় অতিবাহিত করছে। এরই মধ্যে অনেকে হারিয়েছেন তাদের অনেক আপনজনকে। কেউবা জানাজার নামাজেও উপস্থিত থাকতে পারছেন না পুলিশী আতংকের কারণে। এ যেন অমানবিকতার জঘন্য রুপ। সর্বত্র যেন কান্নার আওয়াজ, বেদনার হাহাকার ঘিরে ফিলেছে গোটা জাতিকে অক্টোপাশের মত। হিংসা বিদ্বেষ আর জিঘাংসার ছড়াছড়ি যেন সর্বত্র। হত্যা, খুন আর গুমের এক অদৃশ্য ছায়া যেন তাড়া করছে সাধারণ মানুষকে প্রতিটি মূহুর্তে। কোথাও যেন স্বস্তির বাতাস নেই। গোটা বাংলার আকাশ আজ কালো মেঘে ঢাকা। নিশ্চয় এর অবসান করতে হবে আমাদেরকে।
যারা শহীদ ভাই-বোনদেরকে ভালোবাসেন, তাদের দায়িত্ব হচ্ছে শোককে শক্তিতে পরিণত করে এই আন্দোলনকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া। আমরা আমাদের প্রিয় সাথী-ভাইদেরকে হারিয়েছি। কিন্তু এর শেষ কোথায়? আর কত মায়ের বুক খালি হবে? আর কত ভাই-বোনের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হবে? আর কত দিন হত্যা, সন্ত্রাস, লুণ্ঠন চালিয়ে যাবে ছাত্রলীগের মানুষরূপী নরপশুরা। সত্য-মিথ্যার চিরন্তন আদর্শিক দ্বন্দের সাহসী সৈনিকদের বিশ্বাস আর নির্মাণে ছিলেন অকুতোভয়। দীপ্ত পথচলা আর আল্লাহভীতি ঘিরেই তাদের জীবন। আজ তারা আল্লাহর মেহমান, তারা সবকিছুর উর্ধ্বে। কিন্তু আমরা জানি, শাহাদাত এ আন্দোলনকে পিছিয়ে দেয়নি বরং এগিয়ে নিয়েছে বহুদূর। এ সীমানা পরিমাপ আমাদের সাধ্যের বাইরে। আর আমাদের দায়িত্বের পরিধিও বেড়ে গেল অনেক দূর। সে সীমানাও অজানা।
প্রিয় ভাইদের হারিয়ে আজ আমরা শোকাহত। বৃদ্ধ বাবা-মা আর পরিবারের সদস্যরা তাদেরকে হারানোর বেদনায় জ্বলতে থাকবে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ, প্রতিটি মুহূর্ত। মহান রবের দরবারে সন্তান হারা মায়ের আহাজারি আর প্রতিরাতে তাহাজ্জুদের নামাজ শেষে চোখের পানি কি কোনই কাজে আসবেনা? অবশ্যই আসবে। একদিন তারা আল্লাহর সম্মানিত অতিথি হবেন শহীদের পিতা মাতা হিসেবে। সেদিন জান্নাতের সবুজ পাখি হয়ে উড়তে থাকবেন শহীদেরা। এটাই তো শহীদের চূড়ান্ত সফলতা! ন্যায় ও বাতিলের এই দ্বন্দ্ব কোন সাময়িক বিষয় নয়, এটি চিরস্থায়ী আদর্শিক দ্বন্দ্বেরই ধারাবাহিকতা মাত্র। শাহাদাত ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবের সিঁড়ি, কর্মীদের প্রেরণার বাতিঘর, উজ্জীবনী শক্তি, নতুন করে পথচলার সাহস। আর খুনীরা হয় ক্ষতিগ্রস্থ ভীত ও সন্ত্রস্ত। কেননা ওদের সত্ত কলুষিত। তবে আমাদের বিশ্বাস এই দুনিয়ার আদালতে এই সকল হত্যার নায্য বিচার না হলেও আল্লাহর আদালত থেকে খুনিরা রেহাই পাবে না।
সর্বোপরি মহান মাবুদের কাছে ফরিয়াদ হে আল্লাহ তুমি আমাদেরকে সকল ত্যাগের বিনিময়ে বাংলার জমিনে দ্বীন কায়েমের তাওফিক দাও।
আমাদের প্রিয় কবি মতিউর রহমান মল্লিক এর কবিতার দুটি লাইন দিয়ে ইতি টানছি-
-“এ আকাশ মেঘে ঢাকা রবেনা,
আলোয় আলোয় হেসে উঠবে-
(সমাপ্ত)