বিশ্বনন্দিত ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম নেতা, মুসলিম উম্মাহর বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার, থিংকার, লেখক-গবেষক, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সম্মানিত আমীর, সাবেক সফল মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। যিনি সারা জীবন মানবতার মুক্তির জন্য সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁকে তথাকথিত মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে দীর্ঘ প্রায় ৬ বছর কারাগারে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তাঁর খেদমত থেকে বঞ্চিত হয়েছে দেশ ও জাতি। সাহচার্য্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে পরিবার, শুভাকাঙিক্ষ ও শুভানুধ্যায়ী। জনাব নিজামী আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে ধৈয্যেও সাথে আইনী প্রক্রিয়ায় সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেছেন। সর্বশেষ মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ আগামী ৫ মে রিভিউ শুনানির রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেছে। আইনি প্রক্রিয়ায় দুনিয়ার আদালতে এটিই চূড়ান্ত রায়। এ রায়ে জনাব নিজামী ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করেন।
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর সাথে কারাগারে আইনজীবীগণ সাক্ষাত করতে গেলে তিনি বলেন, “যে সব সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য প্রদান করেছেন তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। সাক্ষীগণ স্বীকার করেছেন ১৯৮৬ সালের পূর্বে ঐ এলাকায় তারা আমাকে দেখেননি। সাক্ষীদের প্রদত্ত সাক্ষ্য বিবেচনায় নিলে এই মামলায় আমাকে সাজা দেয়ার কোন সুযোগ নেই। আমি আশা করি সর্বোচ্চ আদালত ন্যায় বিচার নিশ্চিত করবেন এবং আমি খালাশ পাব ইনশাআল্লাহ।
তিনি আইনজীবীদেরকে বলেন, ব্যক্তিগতভাবে, আমার রাজনৈতিক জীবনে আমি কখনো আমার জানামতে কোন মানুষকে মনোকষ্ট দিয়েছি এমন কোন নজির নেই। শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই সরকার আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে আমাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। আমি যে আদর্শের রাজনীতি করি সে আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য আমি সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত আছি। তিনি পরিবারের সদস্য ও ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে ধৈর্য্যরে সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ধৈর্য্যের পুরস্কার আল্লাহ তায়ালা দিবেন বলে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে ঘোষণা করেছেন। মাওলানা নিজামী আইনজীবীদের মাধ্যমে দেশবাসীকে সালাম জানান ও তার জন্য দোয়া করতে বলেন।”
প্রখ্যাত আলেম দ্বীন ও ইসলাম প্রিয় জনগণের রুহানি উস্তাদ তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত ভদ্র, মার্জিত, পরিশীলিত, মৃদুভাষী এক অসাধারণ ইসলামী ব্যক্তিত্ব। সুদীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছরের রাজনৈতিক জীবনে দেশবাসীর কল্যাণে নিবেদিত মাওলানা নিজামীর ব্যক্তিত্ব দেশবাসীর হৃদয়ে তাদের প্রিয় নেতা স্থান করে নিয়েছে। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মাওলানা নিজামীর বলিষ্ঠ ভূমিকা বাংলাদেশের মর্যাদাকে বহির্বিশ্বের কাছে উজ্জ্বল করেছে। ২০১৫ সালে আমেরিকার বিখ্যাত “দ্যা রয়েল ইসলামিক স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ সেন্টার” প্রকাশিত তালিকায় বিশ্বের ৫০০ জন প্রভাবশালী মুসলিম ব্যক্তির তিনি অন্যতম। দূর্নীতিমুক্ত ও ইনাসফভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের সংগ্রামে অগ্রসেনানী।
জনাব নিজামী ১৯৯১ এবং ২০০১ সালে মোট দুইবার তিনি বিপুল ভোটে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে তিনি বাংলাদেশের কৃষি ও শিল্পমন্ত্রী হিসাবে সর্বমহলে নিজেকে একজন সৎ, দক্ষ ও অমায়িক নেতার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। জেল-জুলুম, নির্যাতন আর রক্তাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে তিনি নিজেই এখন মজলুমের এক আবহ। বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রাম, শিক্ষা আন্দোলন, ১/১১ বিরাজনীতিকরণের ষড়যন্ত্র, কেয়ার-টেকার সরকার আন্দোলন, সা¤্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে তিনি আপোষহীন বীরপুরুষ। এদেশের মানুষের তাহজীব-তামুদ্দুন, ধর্ম-বর্ণ, নির্বিশেষে সবার অধিকার রক্ষার আন্দোলনে তিনি আছেন প্রথম কাতারে। এ কারণে তাঁর জীবননাশের চেষ্টাও হয়েছিল অনেকবার। নাস্তিকতাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের রক্তচক্ষু মোকাবেলা করে আসা একজন সংগ্রামী প্রাণপুরুষ তিনি। নীতির প্রশ্নে সদা আপোষহীন এই মানুষটি কেবলমাত্র ইসলামী আন্দোলন করার আপরাধে ফাঁসির মুখোমুখি আজ দন্ডায়মান। সরকার শুধুমাত্র আদর্শিক কারণেই ইসলামী আন্দোলনের এই জনপ্রিয় নেতাকে হত্যার পাঁয়তারা করছে।
একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নতি এবং সমৃদ্ধি নির্ভর করে আইনের শাসনের ওপর। আইনের শাসন ছাড়া একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ করা অসম্ভব। কিন্তু তা হতে হবে ন্যায় এবং ইনসাফের ভিত্তিতে। প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, আইনগত, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পূর্ণ অধিকার ভোগ করার নিশ্চয়তা দিতে হবে রাষ্ট্রকেই। কিন্তু বর্তমানে দেশে আইনের ভুলুণ্ঠিত। নাগরিকরা তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বলা হয়েছে- “নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি সুস্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাদের সঙ্গে দিয়েছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে।” (৫৭:২৫) আল্লাহ বলেন,“আল্লাহ ন্যায়-নীতি, পরপোকার ও আত্মীয়-স্বজনদের দান করার হুকুম দেন এবং অশ্লীল-নির্লজ্জতা ও দুষ্কৃতি এবং অত্যাচার-বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষালাভ করতে পারো।” (১৬:৯০)। অন্যত্র বলা হয়েছে-“আল্লাহ তা’আলা কি বিচারকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম বিচারক নন?”(৯৫ঃ৮) তাই এডিসন বলেছেন- ন্যায়বিচারের মতো প্রকৃত মহৎ ও ঈশ্বরতুল্য সদগুণ আর নেই।
পৃথিবীতে ইনসাফ কায়েমের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ দেখিয়েছেন মানবতার বন্ধু হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)। মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল বিচার বিভাগ। রাসূল (ﷺ) ছিলেন তাঁর সুমহান বিচারক। আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন যেই সাত ব্যক্তিকে আরশের নিচে ছায়া দিবেন তার অন্যতম হল একজন ন্যায়বিচারক শাসক (মুসলিম)। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) বলেন, “একটি সুষ্ঠু বিচারকার্য পরিচালনা করা আমার নিকট সত্তর বছর নফল ইবাদাতের চেয়েও উত্তম।” রাসূল (ﷺ) বলেছেন- “আল্লাহ তায়ালা একজন বিচারকের সাহায্যে থাকেন ততক্ষণ, যতক্ষণ সে নিজেকে যুলুম অবিচার থেকে বিরত রাখে, আর যখন সে তাতে নিমজ্জিত হয় তখন তার সঙ্গী হয় একমাত্র শয়তান।” (হাকেম, বায়হাকী)
এদিকে নিজামীর আইনজীবি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন- “ন্যায়বিচার হলে নিজামী খালাস পাবেন।” একই কথা বলেছেন প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক- “একজন আইনজীবি হিসেবে আমি বলতে চাই, মানবতাবিরোধী অপরাধে যে চারজনকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন আইনের অধীনে বিচার হলে, তাদের কারোরই ফাঁসি হতো না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেভাবে বিচার করতে বলেছে, সেভাবে বিচার করা হলে কারোরই ফাঁসি হতো না বলে আমি মনে করি। সকলেই মুক্তি পেতেন।”
জনাব নিজামীর আইনজীবী বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনায় নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলেও সাক্ষীদের বক্তব্যে অসামঞ্জস্যতা পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ড. আলীমের স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী দুটি বই লিখেছেন। এর মধ্যে একটি হলো ‘একাত্তরে শহীদ ডা. আলীম’। এ বইয়ে নিজামী বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত ছিলেন বলে শ্যামলী নাসরিন উল্লেখ করেননি। বুদ্ধিজীবী আজহারুল ইসলামের স্ত্রী সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন শাহরিয়ার কবিরের কাছে। সেখানেও নিজামী বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ করেননি। তাই সরাসরি মতিউর রহমান নিজামী যেহেতু জড়িত ছিলেন না, তাই তাঁকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া যাবে না।
প্রধান বিচারপতির প্রশ্ন
জামায়াতের আমির নিজামির আপিল শুনানিতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে বেশ কিছু প্রশ্ন করেছেন। এতে তিনি জিজ্ঞেস করেন, নিজামীর সরাসরি জড়িত থাকার বিষয়ে আপনাদের কাছে তো কোনো প্রমাণ নেই। এতে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া যাবে কি?
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এবং হত্যাও সংঘটিত হয়েছে এ বিষয়গুলো তো নিজামীর আইনজীবীরা স্বীকার করেছেন। কিন্তু নিজামী সরাসরি হত্যা, ধর্ষণে জড়িত ছিলেন এমন কোনো প্রমাণ আপনাদের কাছে আছে? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এ ট্রাইব্যুনাল আইনে সরাসরি হত্যায় জড়িত থাকতে হবে এমন কোনো বিধান নেই। এ আইনে হত্যায় কাউকে উৎসাহিত করলে বা উসকানি দিলে তাও অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। প্রধান বিচারপতি আবারও বলেন, আল-বদর বাহিনীর হয়ে নিজামী বক্তব্য দিয়েছেন এটা ঠিক আছে। কিন্তু তাঁর সরাসরি অংশগ্রহণ কোথায়? প্রধান বিচারপতি আবার প্রশ্ন করেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে সরাসরি অংশ গ্রহণ না থাকলে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া যাবে কি?
প্রধান বিচারপতি বলেন, এ মামলার রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, ‘৭১-এ শহীদ ডা. আলীম চৌধুরী’ নামক বইয়ে নিজামীর নাম উল্লেখ করেননি। কিন্তু সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তিনি ট্রাইব্যুনালে বলেছেন, বুদ্ধিজীবী হত্যায় মতিউর রহমান নিজামী উসকানি দিয়েছেন।’ একই ব্যক্তির দুই রকম বক্তব্য হওয়ায় এতে করে নিজামীর জড়িত থাকার বিষয়ে সন্দেহ থেকে যায়। তখন কি বইয়ে নিজামীর নাম বলা যেত না? প্রধান বিচারপতি বলেন, নিজামীর ৭১ সালের ঘটনা অস্বীকার করছেন না। কিন্তু সরাসরি জড়িত থাকার বিষয়ে উল্লেখ করতে পারলেন না। (সূত্র: শীর্ষ নিউজ)
এ.কে. ফজলুল হক বলেছিল-“বিচারালয় আল্লাহর দরবার, বিচারের মালিক আল্লাহ। মানুষ তাঁহার প্রতিনিধি হিসাবে বিচারাসনে বসে। সেখানে মিথ্যার স্থান নাই”। যে ব্যক্তি মুসলমানদের বিচার কাজে নিযুক্ত হয় অত:পর তার ন্যায় বিচার সদাসর্বদা জুলুম-অত্যাচার থেকে বিজয় লাভ করে তার জন্য রয়েছে জান্নাত, আর যার জুলুম-অন্যায় রায় ন্যায় বিচারের উপর বিজয় লাভ করে তার জন্য রয়েছে জাহান্নাম (আবু দাউদ)। রাসুল (ﷺ) বলেছেন, “বিচারক তিন ধরনের- দুই ধরনের জাহান্নামী এক ধরনের জান্নাতী, যে সত্য জেনেও অন্যায় বিচার কার্য করে সে জাহান্নামী, যার বিচার কার্যের জ্ঞান না থাকা সত্বেও বিচার কার্য করল সে জাহান্নামী, আর যে সত্যকে জানলো এবং সে অনুযায়ী বিচার রায় দিল সে জান্নাতি।” (ইবনে মাজাহ) রাসূল (ﷺ) আরও বলেছেন, “কাউকে যখন বিচার কার্যে নিযুক্ত করা হয় তাকে যেন ছুরি ছাড়া জবেহ করা হল।”
সক্রেটিস বলেছিল- “চারটি জিনিস বিচারকের নিজস্ব থাকতে হবে ঃ বিনয়সহকারে শুনা, জ্ঞানীর মতো উত্তর দেয়া, সংযত হয়ে বিবেচনা করা, কোনোদিকে পক্ষপাতিত্ব না করে বিচার করা। বাংলাদেশের সংবিধানের বিচারকের শপথ বাক্যে তেমনি বিষয় উল্লেখ করা আছে। ইসলামে সেই সকল বাদী-বিবাদী সম্পর্কেও সতর্ক করা হয়েছে, যারা তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এবং সাক্ষ প্রদান করে।
মিথ্যা সাক্ষ্যদানকে তিনি শিরকের সমতুল্য বড় গুনাহ বলে উল্লেখ করেছেন। যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়, মিথ্যা সাক্ষ্যদানে উদ্বুদ্ধ করে এবং জেনে-বুঝে এর পক্ষাবলম্বন করে এরা সবাই মুশরিক, জালেম ও জাহান্নামী। ব্ল্যাক স্টোন বলেন, “একজন নির্দোষ ব্যক্তিকে ভোগানোর চেয়ে দশজন দোষী ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া ভালো।” আয়েশা (রা:) বর্ণিত হাদিস- “মুসলমানদের ওপর থেকে শাস্তি যতটা পারো রহিত করো। তাকে অব্যাহতি দেয়ার সুযোগ থাকলে অব্যাহতি দাও। কেননা শাসকের জন্য ভুলক্রমে শাস্তি দেয়ার চেয়ে ভুলক্রমে মাফ করা উত্তম।” আল্লাহ তায়ালা বলেন, “অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা গোটা মানবজাতিকে হত্যার শামিল।”
হযরত আলী (রাঃ) বলেছিলেন- “ক্ষমতাপ্রাপ্ত রাজপুরুষের অত্যাচার ও বিচারাসনে বসিয়া বিচারকের অবিচারের মতো মন্দ কর্ম আর নেই।” আজ বাংলাদেশ সরকার যে আইন দিয়ে কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত, সমালোচিত, বিতর্কিত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত, কালো আইন হিসেবে খ্যাত। যুক্তরাজ্যের হাউজ অব লর্ডস ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক বিশেষ দূত স্টিফেন জে র্যাপ সাফ বলেছেন-“১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে প্রণীত আইন যথেষ্ট নয়।“
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এশিয়া বিভাগ, দ্যা ওয়ার ক্রাইমস কমিশন অব দ্যা ইন্টারন্যাশনাল বার এ্যাসোসিয়েশন, দ্যা ওয়ার ক্রাইমস প্রজেক্ট ও অ্যামনে¯িট ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রয়োজনীয় সংশোধন ছাড়া এই আইনের মাধ্যমে বিচারকাজ চালিয়ে গেলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিতর্ক বাড়বে।” বিশ্বের বড় বড় সংবাদ মাধ্যমগুলো আশঙ্কা করে আসছে, সরকার তার পরিচিত প্রতিপক্ষ এবং রাজনৈতিক শত্রুদেরকে দমন করতেই এ বিচারকে ব্যবহার করছে।” জনাব নিজামীর মৃত্যুদন্ডের এ রায়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ব্যক্তিত্ব তাদের উদ্বেগ অব্যাহত রেখেছে। তাই বেকন বলেছিলো-“আইনের মাধ্যমে অত্যাচার করার চেয়ে বড় অত্যাচার আর নেই”। বাংলাদেশ আজ সেই ভয়ংকর সময়টি অতিক্রম করছে।
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ব্যক্তিগত জীবনে একান্তই সৎ, নিজের পরিচালিত দু’টি মন্ত্রণালয়কে দুর্নীতিমুক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এবং তার পরিচালিত সংগঠনকে সততা, দক্ষতা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে পরিচালনার ক্ষেত্রে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এ কথা মন্ত্রণালয়ের অনেক সচিব এবং বিভিন্ন জেলার ডিসিও জানেন। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ মন্ত্রী থাকাকালীন ডিসি অফিসে খাবার ব্যাপক সুযোগ সুবিধা খুব কমই গ্রহণ করেছেন। এটি ছিল এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আইয়ুব কাদরী কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকাকালীন যখন মাওলানা নিজামীর মন্ত্রণালয় পরিবর্তন হচ্ছেÑ তিনি বিদায়ী বক্তব্যে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘‘আমার দীর্ঘ দায়িত্ব পালনে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মতো এমন একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, আন্তরিক মানুষ আর পাইনি। এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে কোন সচিবের মুখে মন্ত্রী সম্পর্কে সততার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দলীয় অফিসে যাওয়ার ক্ষেত্রে পর্যন্ত তিনি সরকারি গাড়ি ব্যবহার করতেন না।
বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ হিসেবে যারা ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন তাদের মধ্যে শহীদ হাসান-আল বান্না, সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী, সাইয়েদ কুতুব শহীদ, মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযম এর পরই স্থান করে নিয়েছেন মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। ঈমান-ইলম, আমল, সংগঠন পরিচালনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তিনি যেন মাওলানা মওদূদীর-ই প্রতিচ্ছবি ধীশক্তিসম্পন্ন। স্থির চিন্তার এই ব্যক্তিকে বিশ্ববাসী দেখেছে পল্টনের ২৮ অক্টোবর রক্তাক্ত প্রান্তরে। এমনই এক দিনে মাওলানা মওদূদীর সম্মেলনে যখন হামলা চালানো হয়েছিল। মাওলানা মওদূদীকে লক্ষ্য করে যখন মুহুর্মুহু গুলি করা হচ্ছিল তখন সবাই বসে পড়ল। আর চিৎকার করে সবাই বলল, মাওলানা বসুন বসুন! সেদিন তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বললেন, আমিই যদি বসে যাই তাহলে দাঁড়িয়ে থাকবে কে? তাঁর আল্লাহর প্রতি অগাধ তাওয়াক্কুল সেদিন সবাইকে উজ্জীবিত করেছিল। ঠিক তেমনি ২৮শে অক্টোবর ১৪ দলের সন্ত্রাসীদের মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ স্তব্ধ করতে পারেনি মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে। অসংখ্য ভাইয়ের শাহাদাত, আহত, রক্তাক্ত জমিনে দাঁড়িয়েও মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর তেজোদীপ্ত কণ্ঠ ছিল। ছিলেন আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুলে ভরপুর। তিনি ছিলেন পাহাড়ের মতো অটল এবং অবিচল।
আল্লাহ বলেন : “তোমরা ঈমান এনেছ এ কথা বললেই তোমাদের ছেড়ে দেয়া হবে না। বরং পরীক্ষা করা হবে যেমনি পরীক্ষা করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে। হযরত আলী (রা) বলেন, “অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অত্যাচারিতদের অন্তরে যে বিদ্বেষ জন্ম হয় তা অত্যাচারীকে ভস্ম করেই ক্ষান্ত হয় না সে আগুনের শিখায় অনেক কিছুই দগ্ধীভূত হয়।”
তাইতো কবি বলেছেন-
“ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয় গান,
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা দেবে কোন বলিদান।”
যুগে-যুগে নবী-রাসূল ও সত্যপন্থীদের ওপর জেল-জুলমু, অত্যাচার-নির্যাতন, নিপীড়ন হয়েছে নানা ভাবে, নানা কৌশলে। কিন্তু কোন দলন নিপীড়নই ইসলামী আন্দোলনের পথচলা থামিয়ে দিতে পারেনি, এখনও পারবে না, ইনশা-আল্লাহ। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী শুধুমাত্র একজন ব্যক্তিত্বই নয়, এদেশের তৌহিদী জনতার কণ্ঠস্বর, গণমানুষের নেতা, বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ শুধু মিথ্যাই নয়, যুগের শ্রেষ্ঠ মিথ্যাচার।
রাষ্ট্রীয় এই অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে দেশের জনগণ এবং বিশ্বসমাজ। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা, শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে হত্যার পর ইসলামী আন্দোলনের প্রাণপ্রিয় এই শীর্ষ নেতাকে হত্যার সরকারী চক্রান্তে বিক্ষুব্ধ ও ভারাক্রান্ত গোটা বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ। নিরপরাধ এই প্রিয় মানুষগুলোর জন্য আল্লাহর দরবারে বায়তুল্লাহর গেলাফ ধরে আর তাহাজ্জুতে নামাজে চোখের পানিতে জায়নামাজ ভাসাচ্ছে পৃথিবীর লক্ষ-কোটি মানুষ। হে! জীবন-মৃত্যুর মালিক মহান পরওয়ারদেগার তুমি আমাদের ফরিয়াদকে কবুল কর। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের শ্রদ্ধাভাজন নেতৃবৃন্দকে মর্যাদার সাথে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দাও। হে! আরশের মালিক তুমি আমাদের অশ্রুসিক্ত বিনীত আকুতি কবুল কর। আমীন।।