সত্যের পথ সকল যুগেই ছিল কণ্টকাকীর্ণ। যুগে-যুগে সকল নবী-রাসূলগণই কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছেন। কখনো কখনো তাদের জীবন পর্যন্ত আল্লাহর রাহে বিপন্ন হয়েছে। তবুও তাঁরা দমে যায়নি। সেই পথ ধরে খোলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবায়ে আজমাঈনসহ সকল যুগেই সত্যপন্থীরা এই পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এই পরীক্ষা কোন কারণে আসেনি বরং আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তা নির্ধারিত। এটি চিরন্তন। এটি পরিবর্তনের ক্ষমতা কারো নেই। সা’আদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) বলেন, আমি রাসূল (সা)-কে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! মানুষের মধ্যে সর্বাধিক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখিন হবে কারা? জবাবে তিনি বলেন- ‘নবীগণ অতঃপর তাদের অনুরূপগণ। অতঃপর তাদের অনুরূপগণ (অর্থাৎ সম্মানিতগণ, অতঃপর সম্মানিতগণ এবং পর্যায়ক্রমে উচ্চপদমর্যাদায় অধিষ্ঠিতগণ), বান্দা তার দ্বীনের পরিধি অনুযায়ী পরীক্ষিত হবে। অতএব যদি তার দ্বীনের ব্যাপারে কঠিন মজবুত হয় তাহলে তার পরীক্ষাও কঠিন হবে, আর যদি সে দ্বীনের ব্যাপারে নরম হয় তাহলে তার দ্বীনের পরিধি অনুযায়ী তাকে পরীক্ষা করা হবে, এভাবে বান্দার নিকট বালা-মুছিবত আসতেই থাকবে (এবং ক্ষমা হতেও থাকবে) যেন সে পাপমুক্ত হয়ে পৃথিবীতে চলতে থাকে। শায়েখ সা’আদী (রহ) বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই স্বীয় বান্দাদের বিপদাপদ দিয়ে পরীক্ষা করবেন এ জন্য যে, যেন সত্যবাদী, মিথ্যাবাদী এবং ধৈর্যশীল ও ধৈর্যহারা ব্যক্তির মধ্যে সুস্পষ্ট প্রমাণ পরিলক্ষিত হয়।’ (ইমাম তিরমিযী ও ইমাম ইবনু মাজাহ)
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মুহাম্মদ (সা:)-এর উম্মতেরা আজ পর্যন্ত পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে সেই একই পরিস্থিতির সম্মুখীন। আল্লাহ তায়ালা ইসলামী আন্দোলনের বিজয় সংখ্যার ভিত্তিতে নির্ধারিত করেননি। কিন্তু বিজয় এবং তাঁর সাহায্য পাওয়ার জন্য কতগুলো গুণাবলী অর্জনকে বান্দার জন্য বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। যদি বান্দাহ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে এই শর্তগুলো পূরণে সফল হয়, তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাহকে সাহায্য করার ওয়াদা আল্লাহ তায়ালা নিজেই করেছেন। সুতরাং বাতিলের ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত দেখে হতাশ না হয়ে মুমিন বান্দার উচিত আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার জন্য গুণাবলী অর্জনে সচেষ্ট হওয়া। আল্লাহ বলেন- ‘আর তোমরা নিরাশ হয়ো না এবং দুঃখ করো না। যদি তোমরা মুমিন হও তবে, তোমরাই জয়ী হবে।’ (৩:১৩৯)
মক্কায় তখন এমন এক পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। ইসলাম গ্রহণ করলেই তার ওপর বিপদ-আপদ ও জুলুম-নিপীড়নের পাহাড় ভেঙে পড়তো। কোন গোলাম বা গরীব মানুষ ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে ভীষণভাবে মারপিট এবং কঠোর নির্যাতন-নিপীড়নের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত করা হতো। সে যদি কোন দোকানদার বা কারিগর হতো তাহলে তার রুজি-রোজগারের পথ বন্ধ করে দেয়া হতো। সে যদি কোন প্রভাবশালী পরিবারের কোন ব্যক্তি হতো তাহলে তার নিজের পরিবারের লোকেরা তাকে নানাভাবে বিরক্ত করতো ও কষ্ট দিতো এবং এভাবে তার জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলতো। এ অবস্থায় মক্কায় এক মারাত্মক ভীতি ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছিল। এ পরিস্থিতি যদিও দৃঢ় ঈমানের অধিকারী সাহাবীগণের অবিচল নিষ্ঠার মধ্যে কোন প্রকার দোদুল্যমানতা সৃষ্টি করেনি তবুও মানবিক প্রকৃতির তাগিদে অধিকাংশ সময় তাদের মধ্যেও একটা মারাত্মক ধরনের চিত্তচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়ে যেতো। এ ধরনের অবস্থার একটা চিত্র পেশ করে হযরত খাব্বাব ইবনে আরাত বর্ণিত একটি হাদীসে। তিনি বলেন, ‘যে সময় মুশরিকদের কঠোর নির্যাতনে আমরা ভীষণ দুরবস্থার সম্মুখীন হয়ে পড়েছিলাম, সেসময় একদিন আমি দেখলাম নবী (সা:) কাবা ঘরের দেয়ালের ছায়ায় বসে রয়েছেন। আমি সেখানে উপস্থিত হয়ে নিবেদন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাদের জন্য দোয়া করেন না? একথা শুনে তার চেহারা আবেগে-উত্তেজনায় রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো এবং তিনি বললেন, ‘তোমাদের পূর্বে যেসব মুমিনদল অতিক্রান্ত হয়েছে তারা এর চাইতেও বেশি নিগৃহীত হয়েছে। তাদের কাউকে মাটিতে গর্ত করে তার মধ্যে বসিয়ে দেয়া হতো এবং তারপর তার মাথার ওপর করাত চালিয়ে দুই টুকরা করে দেয়া হতো। কারো অঙ্গ-প্রতঙ্গের সন্ধিস্থলে লোহার চিরুনী দিয়ে আঁচড়ানো হতো, যাতে তারা ঈমান প্রত্যাহার করে। আল্লাহর কসম, এ কাজ সম্পন্ন হবেই, এমনকি এক ব্যক্তি সান’আ থেকে হাদরামাউত পর্যন্ত নিশঙ্ক চিত্তে সফর করবে এবং আল্লাহ ছাড়া আর কারো ভয় তার মনে থাকবে না।’ (বুখারী, আবু দাউদ ও নাসাঈ)
ঈমানের প্রত্যেক দাবীদারকে অনিবার্যভাবে পরীক্ষার চুল্লী অতিক্রম করতে হবেই। বিভিন্ন ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতন সহ্য করতে হবে, বিপদ-মুসিবত ও সংকটের মুকাবিলা করতে হবে। আল্লাহ বলেনÑ ‘তোমরা কি মনে করেছো তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করে যাবে, অথচ এখনো তোমরা সে অবস্থার সম্মুখীন হওনি, যে অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী (ঈমানদার)গণ? তারা সম্মুখীন হয়েছিল নির্মমতা ও দুঃখ-ক্লেশের এবং তাদের অস্থির করে তোলা হয়েছিল। এমনকি রাসূল (সা.)ও তার সাথে যারা ঈমান এনেছিল তারা চিৎকার করে বলে উঠেছিল আল্লাহর সাহায্য কবে আসবে? (তখনই তাদের সুখবর দেয়া হয়েছিল এই মর্মে যে) জেনে রাখো, আল্লাহর সাহায্য নিকটেই। (২ঃ২১৪)
আল্লাহ বলেন- আমি তোমাদের অবশ্যই পরীক্ষা করবো যাতে আমি তোমাদের অবস্থা যাঁচাই করে দেখে নিতে পারি তোমাদের মধ্যে কে জিহাদকারী এবং কে ধৈর্যশীল। (সূরা মুহাম্মদের ৩১) রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ যদি সত্যের কালেমা উচ্চারণ এবং মিথ্যা প্রতিরোধের জন্যে যুক্তি প্রদর্শন করে এবং নিজের প্রচেষ্টায় হক-এর সাহায্যের জন্যে কাজ করে সেই ব্যক্তির এই কাজ আমার সঙ্গে হিজরত করার চেয়ে বেশি উত্তম বিবেচিত হবে। রাসূল (সা.) আরো বলেন, ইসলামের পথে কারো এক ঘণ্টার কষ্ট সহ্য করা এবং দৃঢ়পদ থাকা তার ৪০ বছর এবাদতের চেয়ে উত্তম।
হযরত কাতাদা (রা.) বলেন, হযরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) আমাকে বলেছেন যে, রাসূল (সা.) বলেছেন, কেয়ামতের দিন দাঁড়িপাল্লা লাগানো হবে, সদকা খয়রাত যারা করবে তাদের দানের বিনিময়ে, পুরস্কার দেয়া হবে। নামায রোযা হজ্ব ইত্যাদি নেক কাজের বিনিময় দেয়া হবে। এরপর আল্লাহর পথে বিপদ সহ্যকারীদের পালা আসবে। তাদের জন্যে দাঁড়িপাল্লা লাগানোর আগেই তাদের নেক আমল ওজন হয়ে যাবে। তাদের বেহিসাব বিনিময় দেয়া হবে। আলাহ তায়ালা বলেন, ধৈর্যশীলদের তাদের পারিশ্রমিক বিনা হিসেবে দেয়া হবে। (সূরা জুমার, ১০)
দুনিয়ার জীবনে বিপদে-মুসিবতে বিপন্ন অসহায় বান্দারা কেয়ামতের দিন বেহিসাব পুরস্কার পেতে থাকবেন। এই দৃশ্য দেখে দুনিয়ার জীবনে আরাম-আয়েশে বসবাসকারীরা আক্ষেপ করে বলতে থাকবে, আহা দুনিয়ার জীবনে আমার দেহ যদি কাঁচি দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করা হতো তবে আজ আমি অনেক বেশি পুরস্কার লাভ করতাম। অনেক বেশি মর্যাদা স্থায়ীভাবে লাভ করতাম। আল্লাহ বলেন- আর নিশ্চয়ই আমরা ভীতি, অনাহার, প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতির মাধ্যমে এবং উপার্জন ও আমদানী হ্রাস করে তোমাদের পরীক্ষা করবো। এ অবস্থায় যারা সবর করে (সূরা বাকারা-১৫৫) ৩০)
ইসলামী আন্দোলনের উপর জুলুম নির্যাতন যত বেশি আসবে আন্দোলন তত মজবুত ও শক্তিশালী হবে। সেই বিচারে বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলন সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চূড়ান্ত আলামত এখন লক্ষণীয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের উপর হামলা, মামলা ও খুন, গুম, অপহরণ, হত্যা, সন্ত্রাস, লুটপাটসহ তাদের সকল প্রকার জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে আসছে। আর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মদদে এদেশ থেকে ইসলামী আন্দোলনকে নিমূল করতে তথাকথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে নেতৃবৃন্দকে হত্যা করার গভীর ষড়যন্ত্র করছে। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রীয় হত্যাকন্ডের শিকার হয়েছেন শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা। কিন্তু শহীদেরর রক্ত সিড়ি বেয়ে সকল বাধা অতিক্রম করে এদেশে ইসলামী আন্দোলন অনেক জনপ্রিয় ও গণ মানুষের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। তার প্রমাণ বাংলাদেশে স্বাধীনতাত্তোর এই প্রথম জামায়াত ইসলামী স্থানীয় নির্বাচনে এত আশানুরুপ ফলাফল লাভ করেছে। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রসংগঠনের নাম ইসলামী ছাত্রশিবির। এই কাফেলার কর্মীদের ত্যাগ, কুরবানী, ভ্রাতৃত্ব, পরকাল ভীতি এবং নিজেদের পরিশুদ্ধ করার অনেক উপাদানের সন্ধান পেয়েছে এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মাঝে। কারণ যারা আমাদের পিছিয়ে দিতে চায় তাদের অনেক কর্মকান্ডের মধ্যেই আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য কল্যাণ রেখেছেন। প্রতিপক্ষের অপপ্রচার অপবাদ হিংসা-বিদ্বেষ ও উস্কানিমূলক বক্তব্যের কারণে এদেশের জনগণের মনে আন্দোলনকে জানার এক প্রচন্ড আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বেড়েছে মানুষের সহানুভূতি। হাজার হাজার মানুষ এ আন্দোলনে শরীক হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আলহামদুলিল্লাহ।
আজ আমাদের অনেকের জীবনে জেল-জুলুম, নির্যাতন, হত্যা, ফাঁসির রায় এগুলো নতুন হলেও ইসলামী আন্দোলনে তা একেবারেই পুরাতন। আজো পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে মুসলমানদের সাথে চলছে একই অচরণ। মূলত মানুষের ঈমানের পরীক্ষা হয় দুঃখ-কষ্ট ও মুসিবতের সময়। তখন সে আন্দাজ করতে পারে যে, এই পথে সে কতোখানি অবিচল থাকতে সক্ষম। কারণ জান ও মালের ক্ষতির আশঙ্কা হচ্ছে মানুষের মধ্যে সবচাইতে বড়ো দুর্বলতা মূল উৎস। এ জন্য আল্লাহ বলেন- ‘হে নবী! তাদের বলে দিন যে, তোমরা যদি মৃত্যু বা হত্যার ভয়ে পালাতে চাও তো পালিয়ে দেখ; এরূপ পলায়নে তোমাদের কোনোই ফায়দা হবে না। তাদের আরো বলে দিন যে, (তারা চিন্তা করে দেখুক) আল্লাহ যদি তাদের কোনো ক্ষতি করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে তাদের আর কে বাঁচাতে পারে? আর যদি আল্লাহ সিদ্ধান্ত নেন তাদের কোনো উপকার করার, তাহলে তাঁকে আর কে প্রতিরোধ করতে পারে? (তাদের স্মরণ রাখা উচিত যে,) আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে না পাবে পৃষ্ঠপোষক আর না পাবে মদদগার।’ (আহযাব : আয়াত ১৭) (চলবে)
আল্লাহ বলেন- ‘যারা তাদের মালিকের সন্তুষ্টি লাভের জন্য (বিপদ মসিবতে) ধৈর্য ধারণ করে, যথারীতি নামায কায়েম করে, আমি তাদের যে রেযেক দিয়েছি তা থেকে তারা (আমারই পথে) খরচ করে-গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে, যারা (নিজেদের) ভালো (কাজ) দ্বারা মন্দ (কাজ) দূরীভূত করে, তাদের জন্যই রয়েছে আখেরাতের শুভ পরিণাম।” (সূরা হুদ-১১) ইমাম আহমদ আলী (রা) হতে উদ্ধৃত করেন, তিনি বলেন, “বদর যুদ্ধের রাত্রিতে একদা দেখি যে, শুধু রাসূল (সা.) ব্যতীত আমাদের মধ্যে সবাই ঘুমিয়ে রয়েছে, তিনি একটি গাছের নিকটে সালাত আদায় করেছিলেন এবং সকাল হওয়া পর্যন্ত দুয়া করেন।” হে ঈমানদার ব্যক্তিরা,) তোমরা সবর ও নামাযের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও; (যাবতীয় হক আদায় করে) নামায প্রতিষ্ঠা করা (অবশ্যই একটা) কঠিন কাজ, কিন্তু যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের কথা আলাদা।” (২:৪৫) যখন অতি প্রতাপশালী দুষ্ট নেতা (নমরুদ) অশুভ উদ্দেশ্যে ইবরাহীম (আঃ)-এর সাথে থাকা স্ত্রীকে বন্দি করে তখন ইবরাহীম (আঃ) সালাতের প্রতি আশ্রয় নেন। ফলে আল্লাহ তাঁর বিপদ মুক্ত করেন আর ঐ কাফেরের চক্রান্তকে তার প্রতিই নিক্ষেপ করেন। সেই কাফির ইবরাহীম (আঃ) ও তাঁর পরিবারের খেদমতের জন্য হাজেরাকে পেশ করে। আল্লাহ বলেন নিশ্চয়ই এবাদতের জন্য রাত্রিতে উঠা প্রবৃত্তি দলনে সহায়ক এবং স্পষ্ট উচ্চারণের অনুকূল। (সূরা মুজাম্মিল) রাত্রির কিছু অংশে তাঁর উদ্দেশে সিজদা করুন এবং রাত্রির দীর্ঘ সময় তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করুন। (সূরা দাহর-২৬)
সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী লিখেছেন- দ্বন্দ্বের তীব্রতা যতই বৃদ্ধি পায় আদর্শবাদী দল বিরুদ্ধবাদীদের মোকাবেলায় ততই উন্নত চরিত্র ও মহান মানবিক গুণ মাহাত্ম্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে থাকে। কঠিন কঠোরতম পরীক্ষার সময়ও এই দল কোনরূপ মিথ্যা, প্রতারণা ও শঠতার আশ্রয় নেবে না। কূটিলতা ষড়যন্ত্রের প্রত্যুত্তরে তারা সহজ-সরল কর্মনীতিই অনুসরণ করবে। প্রতিশোধ গ্রহণের তীব্র উত্তেজনার সময়ও অত্যাচার-অবিচার, উৎপীড়নের নির্মমতায় মেতে উঠবে না। যুদ্ধেও প্রবল সংঘর্ষের কঠিন মুহূর্তেও তারা নিজেদের নীতি আদর্শ পরিত্যাগ করবে না। কারণ সেই আদর্শের প্রচার প্রতিষ্ঠার জন্যই তো তার জন্ম। এজন্য সততা, সত্যবাদিতা, প্রতিশ্রুতি পূরণ, নির্মল আচার-ব্যবহার ও নিঃস্বার্থ কর্মনীতির ওপর তারা দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকে। যারা আর কিছুই বলেনি-শুধু বলেছে, হে আমাদের পালনকর্তা! মোচন করে দাও আমাদের পাপ এবং যা কিছু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে আমাদের কাজে। আর আমাদিগকে দৃঢ় রাখ এবং কাফেরদের ওপর আমাদিগকে সাহায্য কর। (৩:১৪৭) আল্লাহ বলেন-হে ঈমানদারগণ! ধৈর্য ধারণ কর এবং মোকাবেলায় দৃঢ়তা অবল¤¦ন কর। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক যাতে তোমরা তোমাদের উদ্দেশ্য লাভে সমর্থ হতে পারে
কুরআনে বলা হয়েছে-কাফেররা তাদের কুফরির ব্যাপারে যে দৃঢ়তা-অবিচলতা দেখাচ্ছে এবং কুফরির ঝাণ্ডা সমুন্নত রাখার জন্য যে ধরনের কষ্ট স্বীকার করছে তোমরা তাদের মোকাবিলায় তাদের চাইতেও বেশ দৃঢ়তা, অবিচলতা ও মজবুতি দেখাও। আর তাদের মোকাবিলায় তোমরা দৃঢ়তা, অবিচলতা ও মজবুতি দেখাবার ব্যাপারে পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা করো।(৩:২০০) আল্লাহ বলেন-অবশ্য ধন-সম্পদে এবং জনস¤পদে তোমাদের পরীক্ষা হবে এবং অবশ্য তোমরা শুনবে পূর্ববর্তী আহলে কিতাবদের কাছে এবং মুশরিকদের কাছে বহু অশোভন উক্তি। আর যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর এবং পরহেজগারি অবলম্বন কর, তবে তা হবে একান্ত সৎসাহসের ব্যাপার। (৩:১৮৬) আল্লাহ বলেন- “(সে মুহূর্তের কথাও স্মরণ করো,) যখন তুমি মোমেনদের বলছিলে, (যুদ্ধে বিজয় লাভ করার জন্য) তোমাদের মালিক যদি আসমান থেকে তিন হাজার ফেরেশতা পাঠিয়ে তোমাদের সাহায্য করেন, তাহলে তোমাদের (বিজয়ের জন্য তা কি) যথেষ্ট হবে না।” আল্লাহ বলেন- যদি আল্লাহ তোমাদের সহায়তা করেন, তাহলে কেউ তোমাদের ওপর পরাক্রান্ত হতে পারবে না। আর যদি তিনি তোমাদের সাহায্য না করেন, তবে এমন কে আছে, যে তোমাদের সাহায্য করতে পারে? আর আল্লাহর ওপরই মুসলমানগণের ভরসা করা উচিত। (৩:১৬০)
যখন তোমাদের দুটি দল সাহস হারাবার উপক্রম হলো, অথচ আল্লাহ্ তাদের সাহায্যকারী ছিলেন, আর আল্লাহ্র ওপরই ভরসা করা মুমিনদের উচিত। বস্তুত আল্লাহ্ বদরের যুদ্ধে তোমাদের সাহায্য করেছেন, অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। কাজেই আল্লাহ্কে ভয় করতে থাক, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পারো। আপনি যখন বলতে লাগলেন মুমিনগণকে-তোমাদের জন্য কি যথেষ্ট নয় যে, তোমাদের সাহায্যার্থে তোমাদের পালনকর্তা আসমান থেকে অবতীর্ণ তিন হাজার ফেরেশ্তা পাঠাবেন। অবশ্য তোমরা যদি সবর কর এবং বিরত থাক আর তারা যদি তখনই তোমাদের ওপর চড়াও হয়, তাহলে তোমাদের পালনকর্তা চিহ্নিত ঘোড়ার ওপর পাঁচ হাজার ফেরেশতা তোমাদের সাহায্যে পাঠাতে পারেন। ৩:১২২-১১৫) বাতিলের সকল চক্রান্ত,ষড়যন্ত্র আল্লাহ তায়ালা রুখে দিবেন। আল্লাহ বলেন- তাদের পূর্বে যারা ছিল, তারা চক্রান্ত করেছে। আর সকল চক্রান্ত তো আল্লাহই হাতেই আছে। তিনি জানেন প্রত্যেক ব্যক্তি যা কিছু করে। কাফেররা জেনে নেবে যে, পর জীবনের আবাসস্থল কাদের জন্য রয়েছে। (সূরা রাদ-৪২) কুরআনে অন্যত্র বলা হয়েছে- “নিশ্চয় চক্রান্ত করেছে তাদের পূর্ববর্তীরা, অতঃপর আল্লাহ্ তাদের চক্রান্তের ইমারতের ভিত্তিমূলে আঘাত করেছিলেন। এরপর ওপর থেকে তাদের মাথায় ছাদ ধসে পড়ে গেছে এবং তাদের ওপর আজাব এসেছে যেখান থেকে তাদের ধারণা ছিল না। (সূরা নাহল ২৬)
তাই যুগে-যুগে মর্দে মুজাহিদদের সাহসী উক্তিগুলো দুনিয়াবাসীকে প্রেরণা যোগাতে থাকবে শতাব্দীর পর শতাব্দী। সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ (রহ) কে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে আপনি যদি ক্ষমা চেয়ে কয়েকটি লাইন লিখে দেন, যা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ করা হবে। তাহলে আপনাদের মুক্তি দেয়া হবে। কুতুব জবাব দিলেন, ‘আল্লাহর শপথ! যদি কয়েকটি শব্দ উচ্চারণের ফলে আমাকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে নাজাত দেয় তবু আমি তা বলতে প্রস্তুত নই। আমি আমার রবের দরবারে এমনভাবে হাজির হতে চাই যে, আমি তার ওপর সন্তুষ্ট আর তিনি আমার ওপর সন্তুষ্ট।’ সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ) কে প্রাণভিক্ষা করার কথা বলা হলো। তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “আপনারা মনে রাখবেন আমি কোন অপরাধ করিনি। আমি কিছুতেই তাদের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইব না । কারণ জীবন ও মরণের সিদ্ধান্ত হয় আসমানে, জমিনে নয়।” শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা শাহদাতের পূর্বে বলেছিলেন- “আমি অন্যায়ের কাছে কখনও মাথা নত করিনি, করবো না। দুনিয়ার কোন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রাণভিক্ষা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। জীবনের মালিক আল্লাহ। কীভাবে আমার মৃত্যু হবে তা আল্লাহই নির্ধারণ করবেন। আমি দেশবাসীর কাছে আমার শাহাদাত কবুলিয়াতের জন্য দোয়া চাই।” মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এমন সাহসী উচ্চারণ ও দৃঢ়তা কেবল আল্লাহর উপর ভরসাকারী ঈমানদারগণই দেখাতে পারেন। আমরা দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করি শহীদের রক্ত আর মজলুমের চোখের পানি বৃথা যাবে না। সকল ত্যাগের বিনিময়ে বিজয় অর্জিত হবেই ইনশাল্লাহ। মুমীনের জন্য আল্লাহর সাহায্য খুবই নিকটবর্তী।